শনিবার

২৭ এপ্রিল ২০২৪


১৪ বৈশাখ ১৪৩১,

১৭ শাওয়াল ১৪৪৫

করোনা ‘ফাঙ্গাস’ সম্পর্কে যা জানা প্রয়োজন

ডেস্ক রিপোর্ট || বিজনেস ইনসাইডার

প্রকাশিত: ০১:২৭, ২৭ মে ২০২১   আপডেট: ০১:২৮, ২৭ মে ২০২১
করোনা ‘ফাঙ্গাস’ সম্পর্কে যা জানা প্রয়োজন

ব্ল্যাক ফাঙ্গাস সাধারণত মাটি, গাছ, সার, পচা ফল এবং সবজিতে পাওয়া যায়। ছবি: বিবিসি

ঢাকা (২৬ মে): ভারতে করোনাভাইরাস সংক্রমণের হার কিছুটা কমতে শুরু করলেও কোভিড থেকে সেরে ওঠা রোগীদের মধ্যে বিভিন্ন ধরণের ফাঙ্গাস জনিত সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ায় নতুন করে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে।

ভারতে এর আগে ব্ল্যাক ফাঙ্গাস ও হোয়াইট ফাঙ্গাসের সংক্রমণের খবর পাওয়া গেলেও সোমবার প্রথম বারের মতো ইয়েলো বা হলুদ ফাঙ্গাস সংক্রমণের খবর জানার পর মানুষের মধ্যে নতুন করে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে।

উত্তর প্রদেশের গাজিয়াবাদের হার্ষ ইএনটি হাসপাতালে একজন রোগীর মধ্যে তিন ধরনের - কালো, সাদা ও হলুদ ফাঙ্গাসের উপস্থিতি পাওয়া গেছে।

ফাঙ্গাসের রং কি গুরুত্বপূর্ণ: ভারতে এর আগে কালো ও সাদা বর্ণের ফাঙ্গাস সংক্রমণের খবর পাওয়া গেছে। প্রথমদিকে গুজরাট ও মহারাষ্ট্রে ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের সংক্রমণের খবর পাওয়া গেছে। পরবর্তীতে কর্নাটক, দিল্লি, উত্তর প্রদেশ ও রাজস্থানেও এই ফাঙ্গাসের সংক্রমণ ঘটে। এর কিছুদিন পর বিহারে চার জন হোয়াইট বা সাদা ফাঙ্গাস আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়। এরপর উত্তর প্রদেশেও একই ধরণের কিছু রোগী পাওয়া যায়।

ফাঙ্গাসের রঙ ভিন্ন হলেও এগুলো আসলে একই প্রজাতির ভাইরাসমানুষের মধ্যে এই তিন ধরণের ফাঙ্গাস সম্পর্কে আতঙ্ক রয়েছে। তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন আতঙ্কিত না হয়ে মানুষের এই ফাঙ্গাস সম্পর্কে জানার চেষ্টা করা উচিত।

দিল্লির অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অব মেডিকেল সায়েন্সের পরিচালক রনদীপ গুলেরিয়া সম্প্রতি ভারতের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় আয়োজিত একটি সংবাদ সম্মেলনে এই ফাঙ্গাসগুলো নিয়ে একটি ধারণা দিয়েছেন।

তিনি বলেন, ‘ফাঙ্গাসের সংক্রমণ বোঝাতে কালো, সাদা, হলুদ বিভিন্ন নাম ব্যবহার করা হচ্ছে। এর ফলে এটি সম্পর্কে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। ফাঙ্গাসটি একেক অঙ্গে একেক রকম রঙয়ের হয়ে প্রতীয়মান হতে পারে, কিন্তু এটি আসলে একই জাতের ফাঙ্গাস।’

ডা. গুলেরিয়া বলেন, ‘যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল, তাদের এই ফাঙ্গাসের দ্বারা সংক্রমণের সম্ভাবনা বেশি। সাধারণত তিন ধরণের ফাঙ্গাসের সংক্রমণ দেখতে পাই আমরা - মিউকরমাইকোসিস, ক্যানডিডা অথবা অ্যাসপারগিলাস ফাঙ্গাস সংক্রমণ।’

তিনি বলেন, ‘সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায় মিউকোরমাইকোসিস। এটি পরিবেশেই অবস্থান করে এবং এটি সংক্রামক নয়। যেসব রোগীর কোভিড চিকিৎসার সময় স্টেরয়েড ব্যবহার করা হয়েছে বা যাদের ডায়াবেটিস রয়েছে, তাদের এই ফাঙ্গাসের দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে।’

গুরুগ্রামের ফর্টিস মেমোরিয়াল রিসার্চ ইনস্টিটিউটের প্রধান পরিচালক ডাক্তার রাহুল ভার্গবও মনে করেন আলাদা আলাদা রং থাকলেও ফাঙ্গাসগুলো একই ধরনের। তিনি বলেন, ‘ফাঙ্গাসের ভেতরে কোনো রং নেই। এই ফাঙ্গাসটি যখন নাক ও মুখ থেকে সংগ্রহ করে মাইক্রোস্কোপের মাধ্যমে দেখা হয়, তখন এর মধ্যে মৃত কোষ দেখা গেছে। 'মিউকর' গ্রুপের ফাঙ্গাস 'রাইজোপাস' শরীরের কোষ মেরে ফেলে এবং মৃত কোষগুলোর কালো একটি দাগ রেখে যায়। সেই থেকে রাইজোপাস ফাঙ্গাসকে ব্ল্যাক ফাঙ্গাস হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এটি এক ধরণের মিউকোরমাইকোসিস।’

অন্য দু'টি ফাঙ্গাস সম্পর্কে ডা. ভার্গব বলেন, ‘শরীরে ক্যানডিডা দেখতে অনেকটা দইয়ের মত দেখায়। তাই এর নাম সাদা ফাঙ্গাস। তৃতীয় এক ধরনের ফাঙ্গাসের নাম অ্যাসপারগিলাস। এটি বিভিন্ন ধরণের হয়ে থাকে। এটি শরীরে কালো, নীলচে সবুজ, হলদেটে সবুজ এবং খয়েরি রংয়ে দেখা যায়। বাইরে থেকে কোন রঙয়ের দেখতে, সেই অনুযায়ী এই ফাঙ্গাসের নাম দেয়ার প্রবণতা দেখা গেলেও এর প্রজাতি নির্ণয় করা না গেলে এর সঠিক চিকিৎসা করা সম্ভব নয়।’

ফাঙ্গাস সংক্রমণের কারণ: প্রত্যেকটি ফাঙ্গাস সংক্রমণের ক্ষেত্রে একটি সাধারণ বিষয় ছিল - যাদের ফাঙ্গাস সংক্রমণ হয়েছে তাদের প্রত্যেকের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল ছিল।

চিকিৎসকরা বলছেন, সুস্থ এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পন্ন মানুষের এই ফাঙ্গাস সংক্রমণ হয় না। এ ফাঙ্গাস পরিবেশে অবস্থান করলেও খুব কম ক্ষেত্রেই সংক্রমণের ঘটনা ঘটে।

কারা ফাঙ্গাস সংক্রমণের ঝুঁকির মধ্যে থাকতে পারেন, সে সম্পর্কে দিল্লির ম্যাক্স হাসপাতালের ইন্টার্নাল মেডিসিন বিভাগের পরিচালক ডা. রোমেল টিক্কু বলছেন:

    -বর্তমানে ফাঙ্গাসের সংক্রমণের হার বেশি হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ করোনাভাইরাস সংক্রমণের হার বৃদ্ধি। সবচেয়ে বেশি মিউকোরমাইকোসিস পাওয়া গেছে কোভিড রোগীদের মধ্যেই।

    -যাদের ডায়াবেটিস আছে এবং যাদের চিকিৎসার জন্য স্টেরয়েড দেয়া হয়েছে, তারা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে। তবে ডায়াবেটিস না থাকলেও যাদের স্টেরয়েড দেয়া হয়েছে, তাদের মধ্যে এই ধরণের সংক্রমণ বৃদ্ধির সম্ভাবনা বেশি।

    -যেসব রোগীর অঙ্গ প্রতিস্থাপন করা হয়েছে, তাদের মধ্যেও ফাঙ্গাস সংক্রমণের সম্ভাবনা বেশি থাকে। পাশাপাশি, কেমোথেরাপি নিতে থাকা বা ডায়ালাইসিস চলতে থাকা রোগীর মধ্যেও এই সংক্রমণের ঝুঁকি থাকে।

করোনাভাইরাস রোগীদের ফুসফুসের প্রদাহ নিয়ন্ত্রণের জন্য স্টেরয়েড ব্যবহার করা হয়। পাশাপাশি করোনাভাইরাস প্রতিহত করতে শরীরের ইমিউন সিস্টেম যখন অতিরিক্ত মাত্রায় কাজ করতে থাকে, তখন স্টেরয়েড শরীরের ক্ষয় রোধ করার কাজ করে।

স্টেরয়েড রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে কিছুটা দুর্বল করে রোগীদের দেহে শর্করার মাত্রা বাড়ায়, যার ফলে ফাঙ্গাসের সংক্রমণের সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়।

কোভিড রোগীদের জীবন বাঁচানোর জন্য স্টেরয়েড ব্যবহার করা হয়শরীরে ফাঙ্গাসের সংক্রমণের বিভিন্ন ধরনের প্রতিক্রিয়া হয়ে থাকে। চিকিৎসার সুবিধার্থে সময়মতো এই ফাঙ্গাস শনাক্ত করা জরুরি।

সংক্রমণের বর্তমান উপসর্গগুলো সম্পর্কে কয়েকজন চিকিৎসক জানিয়েছেন,

মিউকোরমাইকোসিস অর্থাৎ 'ব্ল্যাক ফাঙ্গাস': মিউকোর বা রাইজোপাস ফাঙ্গাসের মাধ্যমে এই সংক্রমণ হয়ে থাকে। এই ফাঙ্গাস সাধারণত মাটি, গাছ, সার, পচা ফল এবং সবজিতে পাওয়া যায়। এই ফাঙ্গাস সাইনাস, মস্তিষ্ক ও ফুসফুসে প্রভাব ফেলে। কয়েকটি ক্ষেত্রে এই ফাঙ্গাসের কারণে পরিপাকতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানা গেছে।

এই ধরণের সংক্রমণের ক্ষেত্রে অনেক ক্ষেত্রেই অস্ত্রোপচার প্রয়োজন হয়ে থাকে। অনেক ক্ষেত্রে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়লে চোখ বা চোয়াল অপসারণেরও প্রয়োজন হতে পারে।

চিকিৎসকদের মতে, এই ফাঙ্গাস ফুসফুস বা পরিপাকতন্ত্র আক্রমণ করলে তা শনাক্ত করা কঠিন, কারণ তখন উপসর্গগুলো দেরিতে প্রকাশিত হয়। মিউকোরমাইকোসিসে মৃত্যুহার প্রায় ৫০ শতাংশ।

এর উপসর্গগুলোর মধ্যে রয়েছে: নাক বন্ধ হয়ে যাওয়া, নাক দিয়ে রক্ত বা কালো তরল নির্গত হওয়া, মাথা ব্যথা, চোখ ফুলে যাওয়া বা ব্যথা, চোখের পাতা খসে পড়া, চোখে ঝাপসা দেখা এবং শেষ পর্যন্ত অন্ধত্ব।

এছাড়া নাকের আশেপাশে কালো ছোট দাগ দেখা যেতে পারে এবং নাকের চারপাশে অসাড়তা তৈরি হতে পারে। ফুসফুসে সংক্রমণের ক্ষেত্রে বুকে ব্যথা এবং শ্বাস-প্রশ্বাসে সমস্যা দেখা দিতে পারে।

মিউকোর সেপটিকাস: এটিও এক ধরণের মিউকোরমাইকোসিস। এর উপসর্গের মধ্যে রয়েছে জ্বর, নাক দিয়ে লাল বা কালো তরল নির্গত হওয়া, দুর্বলতা ও নাকের আশেপাশে অসাড়তা।

'ক্যানডিডা' বা হোয়াইট ফাঙ্গাস: যেসব রোগীর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম এবং যাদের দীর্ঘসময় আইসিইউতে থাকতে হয়েছে, তাদের মধ্যে এই ধরণের ফাঙ্গাস সংক্রমণের সম্ভাবনা বেশি। এই ধরণের সংক্রমণের ক্ষেত্রে জিহ্বায় সাদা ছোপ দেখা যায়। এই সংক্রমণ যকৃত ও ফুসফুসে হয়ে থাকে। এটি মিউকোরমাইকোসিসের মত ভয়াবহ নয়। এর সংক্রমণে মৃত্যুর হার শতকরা প্রায় ১০ ভাগের মত। তবে সংক্রমণ রক্তে ছড়িয়ে গেলে এই ধরণের সংক্রমণ ভয়াবহ রূপ ধারণ করতে পারে।

অ্যাসপারগিলাস সংক্রমণ: করোনাভাইরাস রোগীদের মধ্যে এই ধরণের ফাঙ্গাসের সংক্রমণও দেখা গেছে। তবে এরকম ঘটনা এখন পর্যন্ত খুবই বিরল। এর ফলে ফুসফুসে গহ্বর তৈরি হতে পারে। এই সংক্রমণের ক্ষেত্রে নিউমোনিয়া হলে সংক্রমণ ভয়াবহ রূপ ধারণ করতে পারে।

নিজেকে সুস্থ রাখার উপায়: এই ধরণের ফাঙ্গাস জনিত সংক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা খুবই জরুরি বলে মনে করেন চিকিৎসকরা। করোনাভাইরাস সংক্রমণ থেকে সুস্থ হওয়ার পর রোগীদের ধুলাবালির কাছে যাওয়া থেকে বিরত থাকা উচিত।

যুক্তরাষ্ট্রের সেন্ট্রাল ফর ডিজিজ কন্ট্রোল বলছে, যেসব জায়গায় ছত্রাকের উপস্থিতি আছে সেসব জায়গা এড়িয়ে যাওয়া খুবই কঠিন। চিকিৎসকরাও বলছেন, যেসব ছত্রাকের কারণে মিউকোরমাইকোসিস হয় সেটা পরিবেশে থাকা খুবই সাধারণ ঘটনা।

তবে যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল তারা কিছু পদক্ষেপ নিতে পারে যাতে করে মিউকোরমাইকোসিস সংক্রমণের সম্ভাবনা কমিয়ে আনা যেতে পারে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে-

১. যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল বা সিডিসি বলছে, যেসব জায়গায় অনেক বেশি ধুলোবালি রয়েছে সেসব জায়গা এড়িয়ে চলা। যদি সেসব জায়গা এড়িয়ে চলা সম্ভব না হয়, তাহলে এন৯৫ মাস্ক ব্যবহার করা।

২. প্রাকৃতিক দুর্যোগে যেসব স্থাপনা পানিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সেগুলোর সরাসরি সংস্পর্শ এড়িয়ে চলা। সিডিসি বলছে এসব জায়গা থেকে ছত্রাকের সংক্রমণ হতে পারে।

৩. শরীরের চামড়ায় যাতে কোন ইনফেকশন না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখা। কোথাও কেটে গেলে কিংবা চামড়া উঠে গেলে সেটি যাতে ধুলো-ময়লার সংস্পর্শে না আসে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।

৪. কোভিড-১৯ রোগীদের ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা

৫. রোগীর স্টেরয়েড ব্যবহারের ক্ষেত্রে সাবধানী হতে হবে। ঢাকার বারডেম হাসপাতালে রেসপিরেটরি মেডিসিনের অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন বলেছেন, স্টেরয়েডের ব্যবহার ডায়াবেটিসকে অনিয়ন্ত্রিত করে তুলতে পারে। ফলে ব্ল্যাক ফাঙ্গাসে সংক্রমতি হবার ঝুঁকি বেশি ধাকে।

৬. রোগীকে অক্সিজেন দেবার সময় পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা।

৭. মাস্ক ব্যবহারের ক্ষেত্রে পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা

যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল বলছে, এসব সতর্কতা মূলক ব্যবস্থা নিলেই যে মিউকোরমাইকোসিস সংক্রমণ এড়ানো যাবে সেটি এখনো পুরোপুরি প্রমাণিত নয়।

যেসব রোগীর করোনাভাইরাসের চিকিৎসা চলমান রয়েছে, তাদের অনেকে সুস্থ হয়ে গেলেও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল থাকে। এই ধরণের রোগীর ক্ষেত্রে নিয়মিত চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া উচিত।

বিবিসি বাংলা অবলম্বনে

Nagad
Walton

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়