শুক্রবার

২৬ এপ্রিল ২০২৪


১৩ বৈশাখ ১৪৩১,

১৭ শাওয়াল ১৪৪৫

খাবার নিয়ে অসহায়দের পাশে ‘মেহমানখানা’

সজল সাইখ ও হাসিবুল হাসান শান্ত || বিজনেস ইনসাইডার

প্রকাশিত: ০১:২৮, ৩০ জুলাই ২০২১   আপডেট: ০১:৪২, ৩০ জুলাই ২০২১
খাবার নিয়ে অসহায়দের পাশে ‘মেহমানখানা’

‘মেহমানখানা’য় চলছে খাদ্য পরিবেশনের কাজ। ছবি: বিজনেস ইনসাইডার বাংলাদেশ

ঢাকা (২৯ জুলাই) ঘড়ির কাঁটায় ১২টা ছুঁই ছুঁই। উত্তরের দমকা হাওয়া আর ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। রাজধানীর লালমাটিয়া ডি-ব্লকের সড়ক ধরে এগোতেই চোখে পড়ে কিছু যুবক ফুটপাতের ওপর বিশাল ডেকচি আর চুলা এনে রেখেছেন। খানিকটা সামনে যেতেই চোখে পড়ে সবুজ কাপড়ের উপর সাদা রং দিয়ে লেখা ‘মেহমানখানা’।

এই মেহমানখানায় চলবে বিশাল এক কর্মযজ্ঞ। হাজার হাজার মেহমানদের জন্য আয়োজনের প্রস্তুতি চলছে। বিকেল ৫টায় মেহমানরা আশা শুরু করবেন, ৬টা থেকেই মেহমানদের আপ্যায়ন শুরু হয়ে যাবে। তাই রান্নার কাটাকুটি নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছেন সেচ্ছাসেবীরা।

মেহমানখানায় রান্নার দায়িত্বে আছেন, মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার ইরাজ মাহমুদী। করোনা মহামারিতে চাকরি হারানো ইরাজ, বোন লিজার ডাকে সারা দিয়ে যুক্ত হয়েছেন মেহমানখানায়। ইরাজ সর্বদা রান্নার তদারকি করছেন। ইরাজকে সহযোগিতা করছেন আরও তিন থেকে চারজন ভলান্টিয়ার। 

রান্নার দায়িত্বে থাকা ইরাজ বিজনেস ইনসাইডার বাংলাদেশকে বলেন, ‘লকডাউনে প্রতিদিন ৩ হাজার মানুষকে খাওয়াচ্ছি, এটি অনেক বেশি আনন্দের। এখানে মানুষ শুধু খাচ্ছেন না, বাসার জন্য খাবার নিয়েও যাচ্ছেন।’ 

মেহমানখানার স্বপ্নদ্রষ্টা নাট্যকর্মী আসমা আক্তার লিজা। ২০২০ সালে প্রথম লকডাউনে লিজা কুকুর, কাক, চড়ুই পাখির জন্য খাবার নিয়ে রাস্তায় বের হতেন। কিন্তু একদিন তার চোখে পড়ে ক্ষুধার্ত কিছু শিশু খাবারের দোকানের তালা ভাংছে। সেই বাচ্চাদের প্রতিদিন তার বাসায় খাওয়াতেন। সেই দুই-তিনজন বালককে প্রতিদিন খাওয়ানো দিয়ে শুরু ‘মেহমানখানা’র, আর আজ লিজার মেহমানের সংখ্যা ২৮ শ’ থেকে ৩ হাজার। 

নাট্যকর্মী আসমা আক্তার লিজা বিজনেস ইনসাইডার বাংলাদেশকে বলেন, ‘পাখির খাবার দিয়েছি, কুকুরের খাবার দিয়েছি, কিন্তু মানুষের কথা চিন্তা করিনি। ছোট ছোট বাচ্চাদের কাছ থেকে দেখেছি-শিখেছি, এই শহরের রাস্তায় থাকা মানুষগুলো কত কষ্টে আছে, তখন আমার বুকটা ব্যথায় যেন ফেটে যাচ্ছিল।’ 

এসব কথা বলতে বলতে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন লিজা। অজান্তেই চোখের কোণে অশ্রু এসে জড়ো হয়। লিজা আরও জানান, ক্লান্তিহীনভাবেই এ সকল কাজ পরিচালনা করছেন। শুরুতে চারজন ভলান্টিয়ার থাকলেও এখন তার সংখ্যা ৪০ জন। অনেকে সামর্থ্য অনুযায়ী যে-যা পারেন দিয়ে সহযোগিতা করছেন। 

সারিবদ্ধভাবে বসে খাদ্যগ্রহণ করছেন মেহমানগণ

লকডাউন হলেই লিজা ও তার সহযোগীদের এমন মহতী কাজ চলতেই থাকে। লকডাউন ছাড়া শুক্র ও শনিবার খাবারের এই আয়োজন করে থাকেন। গত রমজানে শুরু থেকেই ইফতারের আয়োজন করেছিল মেহমানখানা। ঈদুল আজহাতেও থেমে ছিল না মেহমানখানা, ১১টি গরু কোরবানি করে বণ্টন করা হয়েছে এসব মেহমানদের মাঝে। 

লিজা বলেন, ‘আলাদাভাবে একটি গরু শুধুমাত্র মধ্যবিত্ত পরিবারের মাঝে বণ্টন করেছি, কারণ তারা কারো কাছে হাত পাততে পারেন না।

মেহমানদের জন্য রান্না প্রায় সম্পন্ন। মোট চারটি ডেকচিতে ৩ হাজার মানুষের রান্না হচ্ছে। রিকশাচালক, পথচারী, দিনমজুর, দারোয়ান, নির্মাণ-শ্রমিক, পথ-শিশুসহ অসংখ্য মেহমানের পদচারণায় সন্ধ্যার আগেই মুখরিত হয়ে ওঠে পুরো এলাকা। সন্ধ্যা ৬টা থেকেই শুরু হয় খাবার বিতরণ। সারিবদ্ধভাবে রাস্তার দু’পাশে রিকশা দাঁড় করিয়ে খাবারের প্লেট নিয়ে আয়েশ করে ফুটপাতেই খেতে বসেন তারা। 

রিকশাচালক সালাম জানান, লকডাউনের শুরু থেকেই তিনি এখানে এসে খান, এই খাবার খেতে কোনো টাকা লাগে না। তিনি উৎফুল্ল স্বরে বললেন,  ‘পেট ভরে খাই আবার নিয়েও যাই। লিজা ম্যাডামের জন্য দুয়া করি, আল্লায় তারে বাচায় রাখুক।’ 

মানুষের বাসা-বাড়িতে কাজ করেন লাইলী বেগম, তিনি বলেন, ‘এমনভাবে কোথাও খাওয়ায় না, তারা খুব ভালো ব্যবহার করে; আমরা বসে থাকি আমাদের কাছে খাবার চলে আসে।’ 

খাবার বিতরণ করা হয় দুটি বুথ থেকে। একটিতে তাৎক্ষণিক খাওয়ার জন্য, অপরটিতে বাড়ি নিয়ে যাওয়ার জন্য খাবার সরবরাহ করা হয়। যারা খাবার বাড়িতে নিয়ে যেতে চান তারা স্বেচ্ছাসেবীদের কাছে পরিবারের সদস্যের সংখ্যা বললেই সেই মতো খাবার দিয়ে দেওয়া হয়।

লকডাউনের মধ্যে প্রতিদিন প্রায় তিন হাজার মানুষকে বিনামূলে খাদ্য পরিবেশ করে ‘মেহমানখানা’

করোনার কারণে লকডাউনের সময় বহু দরিদ্র-মানুষ বিপন্ন। আয়-রোজগার প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়ায় দু বেলা খাবারও জুটছে না। এই মানুষগুলোর কথা চিন্তা করে লিজার এই মহতী কাজে উদ্যোগী হওয়া। আসমা আক্তার লিজা মনে করেন সমাজের ধনীরা এখনো ঘুমিয়ে আছেন, অন্তত এসব হৃত-দরিদ্র মানুষের কথা চিন্তা করেও তাদের সাহায্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া উচিত।

অশ্রুসিক্ত চোখে আসমা আক্তার লিজা বলেন, ‘এই মেহমানখানা আর সামনে এগিয়ে নিতে চাই না; আশা করি দ্রুতই পৃথিবী সুস্থ হয়ে উঠুক, সবাই পেট ভরে খেতে পারুক, সবার মুখে হাসি ফুটুক।’

Nagad
Walton

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়