নয়-এগারোর আলোচিত ব্যক্তিরা এখন কে কোথায়
আন্তর্জাতিক ডেস্ক || বিজনেস ইনসাইডার

১৯৯০ সালে তোলা ছবিতে নিউইয়র্ক সিটির ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের টুইন টাওয়ার। ছবি: এপি
ঢাকা (১১ সেপ্টেম্বর): নয়-এগারো বা যুক্তরাষ্ট্রের টুইন টাওয়ারে সন্ত্রাসী হামলা বিশ বছর পেরিয়ে গেছে। এখনও ১১ সেপ্টেম্বর এলে মার্কিন মুল্লুকে বেশ গুরুত্ব সহাকারে দিনটি পালন করা হয়।
২০০১ সালে ১১ সেপ্টেম্বর এই হামলার পর, এই ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে আল কায়দার শীর্ষ নেতা ওসামা বিন লাদেন ও মোল্লা মোহাম্মদ ওমরের নাম ওই সময় সারা বিশ্বের মানুষ জেনেছে। নয়-এগারোর ঘটনায় আলোচিত এই দুৃই ব্যাক্তিই মারা গেছেন। একই সময়ে আরেক আলোচিত ব্যাক্তি ছিলেন একই সংগঠনের খালিদ শেখ মোহাম্মদ এখনও বেঁচে আছেন।
অন্যদিকে, ভয়াবহ এই সন্ত্রাসী হামলার সময় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ছিলেন জর্জ ডব্লিউ বুশ। ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন রিচার্ড চেনি, যুক্তরাষ্ট্রের সেক্রেটারি অফ স্টেট কলিন পাওয়েল, প্রেসিডেন্ট বুশের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ছিলেন কন্ডোলিজা রাইস। এছাড়া নিউইয়র্ক সিটির মেয়র ছিলেন রুডলফ গিলিয়ানী এবং নিউইয়র্ক সিটির পুলিশ কমিশনার ছিলেন বার্নার্ড কেরিক।
২০০১ সালের ৯/১১ এর পর মার্কিন প্রশাসন টুইন টাওয়ারে হামলার ঘটনায় আল-কায়দাকে অভিযুক্ত করে। এসময় সংগঠনটির বেশ কয়েকজন শীর্ষ নেতাকে ধরতে অভিযান শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র। সন্দেহভাজন অভিযুক্তদের অনেকেই বিভিন্ন সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের পরিচালিত অভিযানে মারা গেছেন।
খালিদ শেখ মোহাম্মাদ আল-কায়দার শীর্ষ নেতা। সংগঠনে নেতৃস্থানীয় প্রচারক হিসেবে পরিচিতখালিদ শেখ মোহাম্মাদ। তাকে ৯/১১ এর ঘটনা নিয়ে গঠিত মার্কিন কমিশন, টুইন টাওয়ারে ১১ সেপ্টেম্বরের সন্ত্রাসী হামলার প্রধান স্থপতি হিসেবে চিহ্নিত করেছে। ৯/১১ এর পর তাকে ধরতে জোর অভিযান শুরু করে মার্কিন প্রশাসন। এর ধারাবাহিকতায়২০০৩ সালে সিআইএ এবং পাকিস্তানের গোয়েন্দা পুলিশের অভিযানে তিনি ধরা পড়েন।
গ্রেপ্তারের পর খালিদ শেখকে পোল্যান্ড ও আফগানিস্তানের সিআইএ কারাগারে এবং সর্বশেষ গুয়ানতানামোর কারাগারে পাঠানো হয়। জিজ্ঞাসাবাদে অসহ্য নির্যাতনের কারণে তিনি আল-কায়েদার প্রায় প্রতিটি বড় অভিযানে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ১৯৯৩ সালে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে বোমা হামলা, ২০০১ সালে সাংবাদিক ড্যানিয়েল পার্ল হত্যাকাণ্ড।
বর্তমানে তার বিচারের তারিখ বারবার পিছিয়ে দেওয়া হচ্ছে। যদিও তিনি অনির্দিষ্টকালের জন্য গুয়ানতানামোর কারাগারে বন্দি রয়েছেন।
জর্জ ডব্লিউ বুশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৪৩তম প্রেসিডেন্ট। ৯/১১ হামলার সময় তিনি ফ্লোরিডার সারসোটায় অবকাশ যাপন করছিলেন। ওখানে বসেই তিনি ৯/১১ হামলার বিষয়টি জানতে পেরেছিলেন।
ওই রাতেই যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের উদ্দেশ্যে তিনি ভাষণ দিয়েছিলেন। এসময় তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন:‘আমি আপনাদেরকে শুনতে পাচ্ছি! বাকি বিশ্বও আপনাদের কথা শুনছে! এবং যারা এখানে হামলা চালিয়েছে তারা শীঘ্রই আমাদের সবার কথা শুনবে।’ এই ঘোষণার তিন দিন পর তিনি হামলার স্থান গ্রাউন্ড জিরো পরিদর্শন করেছিলেন।
বর্তমানে অবসরে যাওয়া এই সাবেক প্রেসিডেন্টের নিদের্শে আল কায়দার শীর্ষ নেতা লাদেনকে ধরতে এবং সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধেও অংশ হিসেবে ইরাক ও আফগানিস্তানের হামলা চালানো হয়। ওইসময় বুশ আফগানিস্তানের তালেবানের উদ্দেম্য করে করেছিলেন, ‘সন্ত্রাসীদেরকে হস্তান্তর করতে হবে, নতুবা এর করুণ পরিণতি ভোগ করতে হবে।’
পরে মার্কিন সরকারের ক্ষমতার পালাবদলে বারাক ওবামা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হন। ওবামার ক্ষমতায় এসে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে অভিযানের মাত্রা আরও বেড়ে যায়। অবশেষে যুক্তরাষ্ট্রের নেভি সীল যখন পাকিস্তানের অটোয়াবাদে বিন লাদেনকে হত্যা করেছিল তখন বুশ টেক্সাসে অবসর জীবন কাটাচ্ছেন। আর প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন আগস্টে যখন আফগানিস্তান থেকে মার্কিন বাহিনী প্রত্যাহার করছিলেন তখন তিনি জানিয়েছিলেন, অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে তিনি পরিস্থিতির অগ্রগতি দেখছেন।
রিচার্ড চেনি জর্জ বুশ সরকারের ভাইস প্রেসিডেন্ট। সন্ত্রাসী হামলার পর আরও হামলা হতে পাওে এই শঙ্কায় প্রেসিডেন্ট বুশকে দেশটির গোয়েন্দা কর্মকর্তারা লুইসিয়ানা এবং নেব্রাস্কায় সামরিক ঘাঁটিতে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়। আর ওই সময় ভাইস প্রেসিডেন্ট চেনি হোয়াইট হাউসের ভিতরে একটি নিরাপদ বাঙ্কার থেকে রাষ্ট্রীয় কার্যক্রম পরিচালনা করেন।
রিচার্ড চেনি যে কোন মূল্যে এই হামলার জবাব দেওয়ার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলেন। এ প্রেক্ষিতেই ২০০৩ সালে ইরাকে হামলা চালানোর প্রয়োজনীয় সকল উদ্যোগ নেন। এসময় সন্ত্রাসীদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহের জন্য তার জিজ্ঞাসাবাদ কৌশল ওয়াটারবোর্ডিং নিয়ে বেশ আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়। তবে তিনি বলতেন এটা কোন ধরনের নির্যাতন নয়।
মার্কিন সরকার ভাইস প্রেসিডেন্টের পদ থেকে অবসরে যাওয়ার পর এখন পর্যন্ত তার পাঁচ দফা হার্ট অ্যাটাক হয়। পরে ২০১২ সালের হার্ট ট্রান্সপ্লান্ট করা হয়। গেল মার্কিন নির্বাচনের সময় ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমালোচনার কারণে তিনি অনাস্থাভাজন (পারসোনা নন গ্রাটা- জিওপি) হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিলেন।
কলিন পাওয়েল জর্জ বুশ সরকারের সময় যুক্তরাষ্ট্রের সেক্রেটারি অফ স্টেট নিয়োগ পান। ২০০১ সালে এই নিয়োগ দেওয়া হয়।এর আগে তিনিজয়েন্ট চিফস অফ স্টাফ ছিলেন। অনেকই মনে করেন কলিন পাওয়েল ইরাকের বিরুদ্ধে সামরিক পদক্ষেপের জন্য জাতিসংঘকে চাপ দিয়েছিল। এসময় সাদ্দাম হোসেন পরমানু অস্ত্র তৈরি করছেন বলে দাবি করেন তিনি। পরে ২০০৩ সালে মার্চ মাসে ইরাকে মার্কিন নেতৃত্বাধীন বাহিনী অভিযান শুরু করে। মার্কিন বাহিনীর হামলা ইরাক ধ্বংস স্তুপে পরিণত হয়, দেশটির প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনকে উৎখাত করে হত্যা করা হয়। কিন্তু যে অভিযোগে ইরাকে হামলা , সেই পারমানবিক অস্ত্রের কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি।
বর্তমানে অবসরে থাকা কলিন পাওয়েল আজীবন রিপাবলিকান পার্টি করেছেন। চলতি বছরের ৬ জানুয়ারি ক্যাপিটল হিলে হামলার পর তিনি রিপাবলিকান পার্টি ত্যাগ করেন। যদিও এর আগেই তিনি ২০১৬ সালে হিলারি ক্লিনটনকে সমর্থন করেছিলেন। ২০২০ ডেমেক্র্যাটিক পার্টির সম্মেলনে তিনি বাইডেনের সমর্থন দিয়েছিলেন।
কন্ডোলিজা রাইস ২০০১ সালে বুশের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ছিলেন। ২০০১ সালের ৯/১১ ঘটনার পর তিনি সিআইএ পরিচালক জর্জ টেনেটের অনুরোধে তার সঙ্গে আমেরিকায় আল-কায়েদার আক্রমণের হুমকি নিয়ে আলোচনা করেন। সিআইএ ওই সময়ে দেওয়া রিপোর্টে উল্লেখ করেছিল যে, ‘আগামী কয়েক সপ্তাহ বা মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে উল্লেখযোগ্য সন্ত্রাসী হামলা হতে পারে।’ একই সময়ে কন্ডোলিজা রাইস বলেছিলেন যে, ওই তথ্য পুরনো।
পাওয়েলের উত্তসুরি পররাষ্ট্র মন্ত্রী হিসেবে কন্ডোলিজা রাইস দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে তিনি স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভোস্ট হিসেবে কাজ করছেন।
রুডলফ গিলিয়ানী নিউইয়র্ক সিটির মেয়র। ২০০১ সালে হামলার ঘটনার পর রুডলফ গিলিয়ানী ওই সময়ে রীতি মতো ‘হিরো’ বনে গিয়েছিলেন। হামলায় স্বজনহারাদের সহানুভূতিশীল, দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, জাতির দুঃসময়ের কেন্দ্রবিন্দু গ্রাউন্ড জিরোতে তার উপস্থিতি ছিল নিয়মিত। ১১ সেপ্টেম্বর তিনি বলেছিলেন, ‘ আমরা যতটা শোক সহ্য করতে পারবো মোট হতাহতের সংখ্যা তার চেয়ে অনেক বেশি হবে।’ অপরাহ উইনফ্রে তাকে ‘আমেরিকার মেয়র’ হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন আর টাইম ম্যাগাজিন তাকে ‘বর্ষসেরা ব্যক্তি’ উপাধি দিয়েছিল।
৯/১১ জরুরি পরিস্থিতির কারণে তার মেয়াদ বাড়ানো হলেও সেই মেয়াদ শেষে গিলিয়ানি লোকচক্ষুর আড়ালে চলে গিয়েছিলেন। এসময় তিনি একটি লাভজনক নিরাপত্তা সংস্থা চালু করেছিলেন। ২০০৮ সালে তিনি প্রেসিডেন্টের পদের জন্য রিপাবলিকান পার্টির মনোনয়ন পেতেও দৌড়ঝাপ করেছিলেন। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমর্থক এবং এজেন্ট হিসেবে তার তৎপরতা সর্বজন বিদিত। এর ফলে নিজ স্টেটে তার আইন পেশার লাইসেন্স স্থগিত করা হয়েছিল।
বার্নার্ড কেরিক নিউইয়র্ক সিটির পুলিশ কমিশনার ছিলেন। ১১ সেপ্টেম্বরের পরের দিনগুলিতে তিনি কখনও গিলিয়ানিকে একা ছাড়েননি। মেয়রকে অফিস ছাড়ার পর তিনি গিলিয়ানি অনুসরণ করে তারই সিকিউরিটি ফার্মে যোগ দিয়েছিলেন।
প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ ২০০৩ সালে ইরাক যুদ্ধের সময় কেরিককে ইরাকের অন্তর্বর্তীকালীন মন্ত্রী নিযুক্ত করেন এবং ২০০৪ সালে তাকে মার্কিন হোমল্যান্ড সিকিউরিটি বিভাগের প্রধান হিসেবে মনোনীত করেন।
পরে আয়া এবং গৃহকর্মী হিসাবে অননুমোদিত শ্রমিক নিয়োগ দেওয়ার বিষয়টি প্রকাশিত হওয়ায় তাকে হোমল্যোন্ডে মনোনয়নের বিষয়টি প্রত্যাহার করা হয়। এছাড়া তার বিরুদ্ধে নৈতিকতা লঙ্ঘন এবং কর জালিয়াতির অভিযাগে দোষী সাব্যস্ত হওয়াসহ আরও বেশ কিছু আইনি সমস্যার মুখোমুখি হন। ২০২০ সালে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প অবশ্য তাকে ক্ষমা করে দিয়েছিলেন। এখন তিনি একেবারেই অবসর জীবনযাপন করছেন।
হামিদ কারজাই অন্তর্বর্তীকালীন নেতা এবং ১১ সেপ্টেম্বরের ঘটনার প্রেক্ষিতে আফগানিস্তানের নির্বাচিত ছিলেন হামিদ কারজাই। তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং পাশ্চাত্যের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ শর্ত বজায় রাখার সঙ্গে সূক্ষ্ম ভারসাম্য রক্ষা করে চলেছেন। দেশের মধ্যে অনেক গোষ্ঠীকে তিনি একত্রিত করেছিলেন। একাধিকবার, তিনি তালেবানকে ‘ভাই’ বলে অভিহিত করেছিলেন। প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালনের পরবর্তী সময়ে তার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছিল।
কিন্তু ২০১৪ সালে তার দ্বিতীয় মেয়াদ শেষ হওয়ার পর তিনি উত্তরাসুরি আশরাফ ঘানির কাছে শান্তিপূর্ণ ভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। আগস্টে তালেবানদের আফগান বিজয়ের পর দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়া আগে ঘানি প্রায় সাত বছর দেশ পরিচালনা করেছেন। বর্তমানে তিনি আফগানিস্তানে আছেন। মার্কিন সরকার প্রত্যাহারের পর তালেবানের সঙ্গে আফগানিস্তান নিয়ে আলোচনা করেন তিনি।