মারা গেলেন বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু সাইমন ড্রিং
নিজস্ব প্রতিবেদক || বিজনেস ইনসাইডার

বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু ব্রিটিশ সাংবাদিক সায়মন ড্রিং
ঢাকা (২০ জুলাই): একাত্তরে পাকিস্তানি বাহিনীর নিধনযজ্ঞের খবর যিনি পৌঁছে দিয়েছিলেন বিশ্বের কাছে বাংলাদেশের সেই অকৃত্রিম বন্ধু ব্রিটিশ সাংবাদিক সাইমন ড্রিং মারা গেছেন।
রুমানিয়ার একটি হাসপাতালে অস্ত্রোপচারের সময় গত শুক্রবার এই প্রখ্যাত সাংবাদিকের মৃত্যু হয় বলে তার আত্মীয় ক্রিস বার্লাস সংবাদ মাধ্যমকে জানান।
সাংবাদিক সাইমন ড্রিং ষাটের দশক থেকে দীর্ঘসময় বিবিসিতে ওয়ার করেসপন্ডেন্ট হিসেবে কর্মরত ছিলেন। বিশ্বের বিভিন্ন সংঘাতময় দেশের যুদ্ধের ওপর তিনি রিপোর্টিং করেছেন।
তিনি ১৮ বছর বয়সে ব্যাংককের ওয়ার্ল্ড নিউজপেপারে সম্পাদনা সহকারী হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। সাইমন ড্রিং ভিয়েতনাম যুদ্ধে রয়টার্স ও অন্যান্য সংবাদ সংস্থাগুলোর হয়েও রিপোর্টিং করেন।
বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে সাইমন ড্রিং গণহত্যার প্রত্যক্ষদর্শী প্রথম বিদেশি সাংবাদিক। জীবন বিপন্ন রেখে সরেজমিন প্রতিবেদন তৈরি করে সারাবিশ্বকে জানিয়ে দেন পাকিস্তানি বাহিনীর লোমহর্ষক নির্যাতন ও গণহত্যার কথা।
শঙ্কা-উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় ভরা ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চের কালোরাতে সাইমন ড্রিং হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে লুকিয়ে ছিলেন। পাকিস্তানের সামরিক আইনের তোয়াক্কা না করে তিনি ২৭ মার্চ তিনি মুক্তিযুদ্ধের সংবাদ সংগ্রহ করে ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় প্রতিবেদন আকারে প্রেরণ করেন।
ওই প্রতিবেদনে ‘ট্যাংকস ক্র্যাশ রিভোল্ট ইন পাকিস্তান’ শিরোনামে (৩০ মার্চ) প্রকাশিত হয়। মহান মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে জনমত সৃষ্টিতে তাঁর এ প্রতিবেদনটি বিশ্বব্যাপী ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছিল।
প্রতিবেদনটিতে তিনি উল্লেখ করেছিলেন, ‘আল্লাহর নামে আর অখণ্ড পাকিস্তান রক্ষার অজুহাতে ঢাকা আজ ধ্বংসপ্রাপ্ত ও সন্ত্রস্ত এক নগর। পাকিস্তানি সৈন্যদের ঠাণ্ডা মাথায় টানা ২৪ ঘণ্টা গোলাবর্ষণের পর এ নগরের…।’
এরপর তৎকালীন পাকিস্তান সরকার তাঁকে জোরপূর্বক দেশ থেকে বের করে দেয়। ইংল্যান্ডে ফিরে গিয়ে পুনরায় নভেম্বর ১৯৭১ সালে কলকাতায় আসেন তিনি। সেখান থেকে তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের যাবতীয় খবরা-খবর নিরপেক্ষভাবে প্রেরণ করতেন। এবং ১৬ই ডিসেম্বর তারিখে বিজয়ের দিনে যৌথবাহিনীর সঙ্গে তিনি ঢাকায় এসেছিলেন।
সাইমন ড্রিং কর্মজীবনে বাইশটি যুদ্ধ কাভার করেন। ১৯৭৯ সালে তিনি খোমেনিকে প্যারিস থেকে ইরানে ফেরত যাওয়ার বিমানে ছিলেন। সাইমন বেশ কয়েকবার আহত হন এবং তাঁকে মৃত্যুদণ্ডের হুমকিও দেওয়া হয়েছিল।
সাইমন আন্তর্জাতিকভাবে অনেক পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৯৭ সালে সাইমন ড্রিং বাংলাদেশের প্রথম বেসরকারি স্যাটেলাইট টেলিভিশন চ্যানেল একুশে টেলিভিশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে যুক্ত হন। বাংলাদেশে আধুনিক টেলিভিশনের নতুন ধারা তৈরি করেন।
প্রসঙ্গত, সাইমন ড্রিং ইংল্যান্ডের নরফোকের ফাকেনহাম শহরে ১১ জানুয়ারি, ১৯৪৫ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি কিংস লিন টেকনিক্যাল কলেজে পড়াশোনা করেন। ১৬ বৎসর বয়সে তিনি গৃহত্যাগ করেন। ১৯৬২ সালে বহিঃবিশ্ব ভ্রমণের অংশ হিসেবে ভারত ভ্রমণে আসেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ শেষে সাংবাদিকতায় যোগ দেন।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রীর শোক
বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু প্রখ্যাত সাংবাদিক সাইমন ড্রিংয়ের মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক এমপি।
বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রদত্ত মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননাপ্রাপ্ত এ ব্রিটিশ সাংবাদিকের মৃত্যুতে আজ মঙ্গলবার এক শোক বার্তায় মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রী তাঁর বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করেন ও শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।
শোকবার্তায় মন্ত্রী বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর বর্বরতার চিত্র সাইমন ড্রিং প্রথম বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরেন। ফলে পাকিস্তানি বর্বর বাহিনী কর্তৃক নিরস্ত্র বাঙালিদের গণহত্যার প্রকৃত ঘটনা বিশ্ববাসী জানতে পেরেছিল। বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতার ইতিহাসে বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু সাইমন ড্রিং -এর অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
স্বাস্থ্যমন্ত্রীর শোক প্রকাশ
প্রখ্যাত সাংবাদিক সাইমন ড্রিংয়ের মৃত্যুতে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক এমপির শোক প্রকাশ করেছেন।
মহান মুক্তিযুদ্ধকালে বাংলাদেশের পক্ষের এক অকৃত্রিম বন্ধু, খ্যাতিমান সাংবাদিক সাইমন ড্রিংয়ের মৃত্যুতে আজ মঙ্গলবার গণমাধ্যমে পাঠানো এক শোক বার্তায় গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন তিনি।
শোক বার্তায় স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সাইমন ড্রিং বাংলাদেশে গণহত্যা, মুক্তিযুদ্ধকালীন বিভিন্ন সংবাদ ও ঘটনা প্রবাহ বিশ্বের গণমাধ্যমে তুলে ধরার মাধ্যমে বিশ্ববাসীকে জানাতে বড় ভূমিকা রেখেছেন। তার প্রচারিত সংবাদ মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের বিজয়কে আরও ত্বরান্বিত করতে ভূমিকা রেখেছে। তাঁর মতো এ রকম একজন গুণী ব্যক্তির মৃত্যুতে বাংলাদেশ একজন শুভাকাঙ্ক্ষী ও পরীক্ষিত বন্ধুকে হারাল।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক এমপি সায়মন ড্রিংয়ের বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করেন ও তাঁর শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।
তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রীর শোক
মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু ব্রিটিশ সাংবাদিক সাইমন ড্রিংয়ের মৃত্যুতে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ডক্টর হাছান মাহমুদ গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন।
সাইমনের প্রয়াণের সংবাদে মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ প্রয়াতের বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা এবং তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্য ও বিশ্বব্যাপী শুভানুধ্যায়ীদের প্রতি সমবেদনা জানান।
ড. হাছান মাহমুদ এক শোকবার্তায় বলেন, সায়মন ড্রিং বাংলাদেশে ১৯৭১ সালে গণহত্যার প্রত্যক্ষদর্শী প্রথম বিদেশি সাংবাদিক, যিনি নিজের জীবন বিপন্ন করে সরেজমিন প্রতিবেদন তৈরি করেন এবং পাকিস্তানি বাহিনীর লোমহর্ষক নির্যাতন ও গণহত্যার কথা সারা বিশ্বকে জানিয়ে দেন। বাংলাদেশের জন্মলগ্নে এই মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননাপ্রাপ্ত এ দেশের অকৃত্রিম বন্ধু সাইমন ড্রিংয়ের অবদান ইতিহাসের পাতায় চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।