জীবন জীবিকা নিয়ে শঙ্কিত মায়ানমারে সংখ্যালঘুরা
আন্তর্জাতিক ডেস্ক || বিজনেস ইনসাইডার

স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চিকিসার অপেক্ষায় সংখ্যালঘু কারেন জনগোষ্ঠীর একজন। ছবি: এপি
ঢাকা (০৫ এপ্রিল): মায়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানের পর এখন নতুন করে জীবন এবং জীবিকা নিয়ে শঙ্কা রয়েছেন সেখানকার সীমান্তবর্তী সংখ্যালঘুরা।
মায়ানমারের উত্তরাঞ্চলের কোচিন রাজ্য থেকে ভিটেমাটি হারিয়ে একটি ক্যাম্পে আশ্রয় নেওয়া লু লু অং এবং তার মতো আরো অনেক কৃষক প্রতিবার বর্ষা শুরুর আগে ফেলে আসা গ্রামে ফিরে সারা বছরের খাবার উপযোগী শস্য আবাদ করেন। কিন্তু ফেব্রুয়ারির সামরিক অভ্যুত্থানের পর তারা আর ক্যাম্প থেকে বের হননি। বর্ষা প্রায় চলে এলেও গ্রামে গিয়ে তারা শস্য আবাদের সাহস পাচ্ছেন না।
তারা এখন বলছেন মায়ানমারের সেনাবাহিনী বা তাদের সহযোগিদের চোখ এড়িয়ে গ্রামে যাওয়া সম্ভব নয়। এভাবে যাওয়া মানে জীবনের ঝুঁকি নেওয়া। লু লু অং বলছিলেন, অভ্যুত্থানের পর থেকে আমি কোথাও যাইনি। কোন কাজও করতে পারছি না। প্রতি রাতেরই আমরা ক্যাম্পের কাছ দিয়ে ফাইটার উড়ে যাওয়ার শব্দ শুনতে পাই।
অভ্যুত্থানের পর থেকেই ইয়াংঙ্গুন বা মান্দালের মতো বড় বড় শহরে বিক্ষোভকারীদের ওপর সামরিক বাহিনীর অভিযান বা হতাহতের ওপরই সবার দৃষ্টি রয়েছে। কিন্তু মায়ানমারের সীমান্তে লু লু অংয়ের মত যে লাখ লাখ সংখ্যালঘু অনিশ্চয়তা আর নিরাপত্তাহীনতায় দিন কাটাচ্ছেন সেটা অনেকেরই নজরে আসছে না। সেখানে তাদের নানা সমস্যার মধ্যে নতুন করে যুক্ত হয়েছে সংখ্যালঘু গেরিলা বাহিনী এবং সামরিক বাহিনীর মধ্যকার দ্বন্দ্ব।
পূর্বাঞ্চলের সীমান্তবর্তী কারেন গেরিলাদের লক্ষ্য করে সেনাবাহিনী বিমান হামলা চালানোর পর সেখানকার হাজার হাজার বাসিন্দা বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে প্রতিবেশি থাইল্যান্ডে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন। এ অবস্থায় বেশ কয়েকটি বিদ্রোহী গ্রুপ বেসামরিক নাগরিক হত্যা বন্ধ না হলে মায়ানমারের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র লড়াইয়ের হুমকি দিয়েছে। এছাড়া উৎখাত হওয়া সরকারের সদস্যরা বিদ্রাহীদের নিয়ে একটি নতুন বাহিনী গঠনের কথা শোনা যাচ্ছে। এ প্রেক্ষিতে মায়ানমারের জন্য নিযুক্ত জাতিসংঘের দূত সেখানে একটি সম্ভাব্য গৃহযুদ্ধের হুশিয়ারি দিয়েছেন।
মায়ানমারের ৫২ মিলিয়ন জনসংখ্যার ৪০ শতাংশই হচ্ছে জাতিগত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার এবং সামরিক বাহিনীতে আধিপত্য রয়েছে জাতিগত বার্মান জনগোষ্ঠীর। ১৯৪৮ সালে ব্রিটেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাতের পর থেকে এক ডজনের বেশী জাতিগত গোষ্ঠী স্বায়ত্বশাসন দাবী করেছে। এদের মধ্যে অনেকেই আবার নিজস্ব বাহিনীও লালন করে। পুরো বিষয়টি নিয়ে মায়ানমারের উগ্রজাতীয়তাবাদী জেনারেলদেরকে বেশ উদ্ভট পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হচ্ছে। সীমান্তবর্তী এলাকাগুলো প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ বলে সেখানে দখল ছাড়ছে না সেনাবাহিনী। মাঝে মধ্যে অস্ত্র বিরতি ছাড়া প্রায় সব সময়ই সেখানকার বিদ্রোহীদের সঙ্গে সেনাবাহিনীর গুলি বিনিময় চলে।
মায়ানমারে সহিংসতার কারণে নানা পক্ষ থেকে বেসামরিক নাগরিকদের ওপর অতিরিক্ত করের বোঝা চাপানো এবং জোর করে সেনাবাহিনীতে নিয়োগসহ বিভিন্ন ধরণের নির্যাতন ও মানবাধিকার লংঘনের অভিযোগ রয়েছে। জাতিসংঘ বলছে ২০১১ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত ২ লাখ ৩৯ হাজার মানুষ তাদের বাড়িঘর থেকে বিতাড়িত হয়েছেন। এর মধ্যে অবশ্য যে আট লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছেন তারা অন্তর্ভুক্ত নন।
ফেব্রুয়ারির অভ্যুত্থানের পর থেকে সীমান্তবর্তী প্রতিটি রাজ্যেই বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। নিরাপত্তাবাহিনীও যথারীতি তাদেরকে প্রতিহত করতে কাঁদানে গ্যাস, রাবার বুলেট এবং অস্ত্র ব্যবহার করেছে। তবে ভৌগলিকভাবে বিচ্ছিন্ন থাকা সীমান্ত এলাকার পরিস্থিতি অভ্যুত্থানের পর সামরিক বাহিনী এবং সংখ্যালঘু বিভিন্ন গ্রুপের মধ্যকার ক্ষমতা এবং এলাকা দখলের লড়াইয়ের কারণে আরো বেশি অবনতি ঘটেছে।
সংখ্যালঘু কোচিন গোষ্ঠীর লু লু অং বলেন, কিছু দিন আগেরও তিনি বিক্ষোভে অংশ নিয়েছেন। কিন্তু আতঙ্কের কারণে এখন আর নিতে পারছেন না। তিনি বলেন, নিরাপত্তাবাহিনী এবং সহযোগি মিলিশিয়ারা তাদের গ্রাম দখলে নিয়েছে। তাই কেউই আর সেখানে শস্য ফলাতে যেতে সাহস পাচ্ছেন না। কারণ, তাদের আশঙ্কা সেখানে গেলেই জোর করে সেনাবাহিনীর জন্য কাজ করতে বলা হবে।
লু লু অং বলেন, আমাদের ছেলে মেয়েরা পড়াশোনা করতে পারছে না। আর তরুণরা অর্থ উপার্জনের জন্য কোন কাজ পাচ্ছে না।
সীমান্ত এলাকার বাসিন্দাদের জন্য কোন মানবিক সাহায্য পৌঁছানোও বেশ কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। একে করোনা ভাইরাসের প্রকোপ তার ওপর রয়েছে বিভিন্ন শসস্ত্র গ্রুপের তৎপরতা। অভ্যুত্থানের পর পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে।
বাস্তুহারাদের সহায়তাকারী একটি সংগঠনের পরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, যোগাযোগ ব্যবস্থা পুরোপুরি ভেঙ্গে পড়েছে। ব্যাংক বন্ধ। আর নিরাপত্তার তো কোনই নিশ্চয়তা নেই। এ অবস্থায় সেখানে কোন ধরণের মানবিক সাহায্য দেওয়া যাচ্ছে না।
তবে, অভ্যুত্থানের পর কোন কোন সীমান্তবর্তী এলাকাতে তেমন কোন প্রভাব পড়েনি বলেও জানা গেছে। চীন এবং থাইল্যান্ডের সীমান্তবর্তী ওয়া রাজ্যের বাহিনী এবং মায়ানমারের সেনাবাহিনীর মধ্যে অস্ত্র বিরতি বজায় রয়েছে। সেখানে করোনাভাইরাসের টিকা দেওয়া হচ্ছে এবং জীবন যাত্রাও স্বাভাবিক রয়েছে বলে একটি ভিডিওতে দেখা গেছে।
বাংলাদেশের কাছে উপকূলীয় রাখাইন রাজ্যের আরাকান আর্মিকে জান্তা সরকার গেল মাসে সন্ত্রাসীর তালিকা থেকে বাদ দিয়েছে। এর ফলে সেখানে সহিংসতা কমে আসার আশা করা হচ্ছে। অন্য সব সশস্ত্র গ্রুপের মতো আরাকান আমি মায়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানের সমালোচনা করেনি। বরং তারা সামরিক অভিযানের বিরুদ্ধে ওই এলাকা এবং বেসামরিক জনগণকে রক্ষার ঘোষণা দিয়ে একটি বিবৃতি দিয়েছিল। এতে সেখানে নতুন করে সহিংসতা বাড়ার আশংকা করা হয়েছিল। কারেন ন্যাশনাল ইউনিয়নের মতো আরো কয়েকটি গ্রুপও একই ধরণের বিবৃতি দিয়ে বলেছিল, তারা বেসামরিক মানুষকে রক্ষার পাশাপাশি অভ্যুত্থান বিরোধী বিক্ষোভে অংশ নেবে।
এ ধরণের প্রতিক্রিয়ার কারণে সারা দেশের জাতিগত সংখ্যালঘু গোষ্ঠীদের সমন্বয়ে একটি ‘ফেডারেল বাহিনী’ গঠনের কথা শোনা যাচ্ছিল। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন এমন লক্ষ্যে পৌঁছা খুব কঠিন। কারণ সেখানে নানা সরঞ্জামের সংকট এবং বিভিন্ন গ্রুপের নেতৃবৃন্দের মধ্যে চরম মতবিরোধ রয়েছে।
সূত্র: এপি