রেশনিং নয়, গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রমে জোর দিতে হবে: ফারহান নূর
হাসান আজাদ || বিজনেস ইনসাইডার

ছবি: বাংলাদেশ সিএনজি ফিলিং স্টেশন এন্ড কনভার্সন ওয়ার্কশপ ওনার্স এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ফারহান নূর
ঢাকা (১৯ সেপ্টেম্বর): আজ রবিবার থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য দৈনিক চার ঘণ্টা বন্ধ থাকবে সিএনজি পাম্প স্টেশনগুলো। সারাদেশে সিএনজি ফিলিং স্টেশন রয়েছে ৫৩৮টি। এর মধ্যে কমবেশি ৫ শ’ সিএনজি স্টেশন চালু রয়েছে। এর বিপরীতে সিএনজি ব্যবহারকারী রয়েছে ৫ লাখ ৪ হাজারের মতো।
সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত এই চার ঘণ্টা বন্ধ থাকার কারণে প্রায় ৫ কোটি টাকার সিএনজি বিক্রি হবে না বলে বলছেন ব্যবসায়ীরা। এতে করে সরকারের কোষাগারে জমা হওয়া রাজস্বের পরিমাণ কমে আসবে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, সিএনজি খাতে মোট গ্যাসের যে পরিমাণ ব্যবহার হয়, তা একেবারেই নগণ্য।
এ ছাড়া, মহামারি করোনাভাইরাসের কারণে লকডাউনে অত্যাবশকীয় পণ্য হিসেবে সিএনজি স্টেশন খোলা রাখা হলেও রাস্তায় গাড়ি চলাচল না থাকায় সিএনজি ব্যবসায়ীদের লোকসান গুনতে হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।
দেশের বর্তমান গ্যাস সংকটও বিদ্যুতে গ্যাস সরবরাহ, সিএনজি রেশনিং কার্যক্রম, সিএনজি খাতে ব্যবসাসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বিজনেস ইনসাইডার বাংলাদেশের সঙ্গে খোলামেলা কথা বলেন বাংলাদেশ সিএনজি ফিলিং স্টেশন অ্যান্ড কনভার্সন ওয়ার্কশপ ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ফারহান নূর।
বিজনেস ইনসাইডার বাংলাদেশ: বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাস সরবরাহে সরকারি সিদ্ধান্তে প্রতিদিন চার ঘণ্টা সিএনজি স্টেশন চার ঘণ্টা বন্ধ থাকবে, সরকারের এই সিদ্ধান্ত নিয়ে আপনাদের মূল্যায়ন কী?
ফারহান নূর: আমরা অবশ্যই সংকটের সময়ে সরকারের এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাই। আমাদের আগে বিদ্যুৎ প্রয়োজন। সরকারের দূরদর্শিতার কারণে বর্তমানে প্রায় শতভাগ বিদ্যুতায়ন হয়েছে দেশ। এই বিদ্যুৎ উৎপাদনে যে প্রাথমিক জ্বালানি ব্যবহার হয়, তার সিংহভাগই হচ্ছে গ্যাস। এ ছাড়া, ডিজেল, ফানের্স অয়েল ও কয়লা রয়েছে। বাংলাদেশে এখনও সাশ্রয়ী বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয় গ্যাস থেকে। কিন্তু এখন বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাসের সংকট চলছে। যে কারণে সরকার সিএনজি খাতের গ্যাস রেশনিং করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর আগেও এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
পেট্রোবাংলা থেকে আমাদের জানানো হয়েছে, এখন আন্তজার্তিক বাজারে এলএনজি (তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) দাম বেড়ে যাওয়ায় এলএনজি কেনা হচ্ছে না। যে কারণে এই খাতে রেশনিং করা হচ্ছে।
বিজনেস ইনসাইডার বাংলাদেশ: প্রায় দুই মাস হতে চলল, দেশে করোনা মহামারির জন্য কোথাও লকডাউন নেই। সিএনজি খাতের ব্যবসায়ীরা বলছেন, মহামারির সময় লকডাউনে তাদের অনেক ক্ষতি হয়েছে। এটা কি ঠিক? যদি ঠিক হয় তাহলে লোকসানের বিষয়টির ব্যাখ্যা কী?
ফারহান নূর: মহামারি করোনাভাইরাসের কারণে গেল দুই বছর দেশের সকল খাতই বিপর্যস্ত। তেমনি সিএনজি খাতও। সিএনজি একটি অত্যাবশকীয় পণ্য। এই কারণে লকডাউনের মধ্যেও আমাদের পাম্প খোলা রাখতে হয়েছে। এ সময় স্টেশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতনভাতা দিতে হয়েছে। এ ছাড়া, লকডাউনের কারণে এসব কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের পাম্পেই থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হয়েছে। এতে করে আমাদের খরচ বেড়েছে দ্বিগুণ। কিন্তু এর বিপরীতে আয় একেবারেই হয়নি। কারণ লকডাউনে একেবারে আবশ্যিক পণ্যেও গাড়ি ছাড়া অন্য কোনো যানবাহন চলেনি। সিএনজি সবচেয়ে বেশি গ্রাহক প্রাইভেটকার ব্যবহারকারীরা। এই ব্যবহারকারীরা ঘরেই ছিলেন। তাই এই সময়টা আমাদের অনেক লোকসান হয়েছে।
বিজনেস ইনসাইডার বাংলাদেশ: এই রেশনিংয়ে এই খাতের কি কোনো ক্ষতি হবে?
ফারহান নূর: লাভ-লোকসানের হিসেব করার আগে আমাদের একটি বিষয় আগে মাথায় নিতে হবে। বর্তমানে দেশে মোট ব্যবহ্নত গ্যাসের মাত্র তিন দশমিক ৫১ শতাংশ সিএনজি খাতে ব্যবহার হয়। যা ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল চার দশমিক ৮১ শতাংশ। তার মানে আগে চেয়ে এই খাতে গ্যাস ব্যবহার কমেছে। কিন্তু এর বিপরীতে এই খাতের ব্যবসায়ীরা গ্যাস ব্যবহ্নত অন্যান্য খাতের চাইতে বেশি রাজস্ব সরকারকে দিয়ে থাকি। এর পরিমাণ ২৪ দশমিক ৬ শতাংশ।
এই অবস্থায় সিএনজি খাতে এই ধরনের রেশনিঙের সিদ্ধান্ত নিলে, সিএনজি ব্যবহারকারীরা নিরুসাহিত হবে। এমনতিই সিএনজির প্রেসার সমস্যার কারণে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে ফিলিং করতে হয়। ব্যবসায়ীরাও বিনিয়োগে নিরুসাহিত হবে। কারণ, এই খাতের ব্যবসায়ীরা কমিশনে ব্যবসা করে। বিনিয়োগের বিপরীরে কমিশনের আয় কমে গেলে স্বাভাবিকভাবেই নিরুৎসাহিত হবে। আমরা প্রতি ঘনমিটার সিএনজি বিক্রি করি ৪৩ টাকা। সরকারকে দিই ৩৫ টাকা। বাকি ৮ টাকা আমাদের কমিশন। এই ৮ টাকা দিয়ে আমাদের সকল ধরনের খরচ মেটানোর পর লাভের হিসেব। এ ছাড়া পরিবেশের ক্ষতি তো আছেই।
বিজনেস ইনসাইডার বাংলাদেশ:পরিবেশের ক্ষতির বিষয়টা যদি ব্যাখ্যা করতেন?
ফারহান নূর: পরিবেশ দূষণরোধেই কিন্তু থ্রি-হুইলার বন্ধ করে সিএনজি চালু হয়েছিল। চলতি বছর বিশ্বের বায়ু দূষণ পর্যবেক্ষণকারী আন্তর্জাতিক সংস্থা এয়ার ভিজ্যুয়ালের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী বাংলাদেশ বায়ুদূষণে বিশ্বে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে। আর ঢাকার বাতাসের অবস্থা খুবই খারাপ। সিএনজি পরিবেশবান্ধব জ্বালানি। সিএনজি ব্যবহার কমলে অন্যান্য ডিজেল, পেট্রোল ও অকটেনের ব্যবহার বাড়বে। এসবের ব্যবহার বাড়লে সঙ্গত কারণে পরিবেশ তথা বায়ু দূষণ বাড়বে। বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বায়ু দূষণের কারণে স্বাস্থ্যের ওপর নানাভাবে প্রভাব ফেলছে। নানা রোগ হচ্ছে। এসব ক্ষতিরও একটা মূল্য রয়েছে। এই ক্ষতি দীর্ঘমেয়াদি। এই বিষয়টির হিসাবও করা প্রয়োজন। এটাও একটা বড় ক্ষতি।
বিজনেস ইনসাইডার বাংলাদেশ: বর্তমানে সিএনজির পরিবর্তে গাড়িতে এলপিজি ব্যবহারও দিন দিন বাড়ছে। এলপিজিও গ্রিন এনার্জি। এটার ব্যবহার ক্রমশ জনপ্রিয় হচ্ছে। সরকারও চাইছে সিএনজির পরিবর্তে এলপিজির ব্যবহার বাড়ুক। এই অবস্থায় আপনাদের অবস্থান কী?
ফারহান নূর: এটা সত্য যে, সিএনজির পরিবর্তে এলপিজির ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে। তারপরেও এখনও সিএনজি ব্যবহারকারী বেশি। আর এলপিজি থেকে সরকার সিএনজির মতো রাজস্ব পাবে না। বর্তমানে সারাদেশে এলপিজির ১০০টির মতো ফিলিং স্টেশন রয়েছে। আর ব্যবহারকারী ১০ হাজারের মতো হবে। ফলে, এখনই সিএনজির বিকল্প এলপিজি এটা বলা যাবে না। এ জন্য আরও অনেক সময় লাগবে।
বিজনেস ইনসাইডার বাংলাদেশ: আপনি বলছেন এই খাত কমিশন নির্ভর ব্যবসায়িক খাত। দৈনিক চার ঘণ্টা বন্ধ থাকার কারণে টাকার অঙ্কে কত ক্ষতি হবে। পাশাপাশি এই খাত থেকে কী পরিমাণ গ্যাস সরকার সাশ্রয় করে বিদ্যুতে সরবরাহ করতে পারবে, এর কোনো হিসেব আপনাদের কাছে আছে কি?
ফারহান নূর: প্রতিদিন চার ঘণ্টা বন্ধ থাকলে, দেশের চালু সিএনজি পাম্পের সংখ্যা ৫ শ’ ধরে হিসেব করলে, দৈনিক চার ঘণ্টার আমাদের ৫ কোটি টাকার মতো বিক্রি কম হবে। বিক্রি কমলে আমাদের কমিশনও কমবে। এটা তো আমাদের ব্যবসার জন্য লোকসান। আর পেট্রোবাংলা থেকে আমাদের জানানো হয়েছে, বর্তমানে পিক আওয়ারে (সবোর্চ্চ চাহিদার সময়) বিদ্যুতে ১১৮০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস প্রয়োজন। যা এখন পেট্রোবাংলা দিতে পারছে না। সিএনজি খাতে রেশনিং করার ফলে এই চার ঘণ্টায় ৮২ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সাশ্রয় হবে বলে পেট্রোবাংলা জানায়। এ ছাড়া আগামী আড়াই থেকে তিন মাসের মধ্যে এলএনজি আমদানি বাড়বে। তখন রেশনিং বন্ধ করা হবে বলেও পেট্রোবাংলা থেকে জানানো হয়েছে।
বিজনেস ইনসাইডার বাংলাদেশ: সিএনজি স্টেশনে গ্যাস রেশনিঙের আগে পেট্রোবাংলার সঙ্গে আপনাদের একাধিকবার আলোচনা হয়েছে। এসব আলোচনায় সিএনজি স্টেশন বন্ধের বিকল্প কোনো প্রস্তাব আপনারা দিয়েছেন কি?
ফারহান নূর: দেখুন বঙ্গবন্ধু জ্বালানি নিরাপত্তার জন্য পাঁচটি গ্যাস ক্ষেত্র ওই সময় কিনেছিলেন। এটা ছিল ওনার দূরদর্শী সিদ্ধান্ত। যে কারণে এখনো বাংলাদেশ নিজের জ্বালানি সম্পদ ব্যবহার করছে। উন্নয়ন করছে। পেট্রোবাংলাকে আমরা বলেছি, দেশের ভেতর গ্যাস অনুসন্ধান কাজ জোরালো করতে। আমদানি করে জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না। আমাদের স্থলভাগে বেশ কয়েকটি স্থানে গ্যাসের আধার রয়েছে বলে আমরা জেনেছি। এই গ্যাস উত্তোলন করতে হবে। আর সাগরেও তেল-গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রম জোরদার করা প্রয়োজন। মোর্দ্দা কথা অনুসন্ধান কাজ যত তাড়াতাড়ি হবে, তত দ্রুতই আমরা জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারব।
বিজনেস ইনসাইডার বাংলাদেশ: আমাদের সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
ফারহান নূর: আপনাদেরও ধন্যবাদ।