হানিফ পরিবহনে ডাকাতি ও চালককে হত্যা
ডাকাত চক্রের ৬ সদস্যকে আটক করেছে র্যাব
নিজস্ব প্রতিবেদক || বিজনেস ইনসাইডার

ছবি: ‘যাত্রীবেশে’ ডাকাতি সংঘটিত করে আসা ডাকাত চক্রের গ্রেফতার ছয় সদস্যের পাঁচজন
ঢাকা (০৫ সেপ্টেম্বর): হানিফ পরিবহনে ডাকাতি এবং চালককে হত্যার সঙ্গে জড়িত সংঘবদ্ধ আন্তজেলা বাস ডাকাত চক্রের ৬ সদস্যকে গ্রেফতার করেছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। গতকাল শনিবার রাতে তাদেরকে আটক করা হয়।
আটক ডাকাত চক্রের সদস্যরা যাত্রীবেশে পরিবহনগুলোতে উঠে এক পর্যায়ে অস্ত্রের মুখে বাসের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ডাকাতি সংঘটিত করে আসছিল বলে র্যাব জানায়।
র্যাব আরও জানিয়েছে, এভাবে চক্রটি হানিফ পরিবহন, শ্যামলী পরিবহন, রত্না স্পেশাল, সিটিবাড়ি স্পেশাল, সৈকত পরিবহনসহ একাধিক বাসে ডাকাতি করে আসছিল।
র্যাবের তথ্য মতে, চক্রটি রাতে রাজধানীর বিভিন্ন বাস কাউন্টার থেকে যাত্রীবেশে আরোহন করে, নির্জন এলাকায় বাস পৌঁছলে বাসচালককে ধারালো ছুরি দেখিয়ে বাসের নিয়ন্ত্রণ নিত। এরপর বাসে থাকা যাত্রীদের কাছ থেকে লুটে নিত মূল্যবান জিনিসপত্র। দীর্ঘদিন বাসে যাত্রীবেশে ডাকাতি করে আসছিল এই চক্রটি।
আজ রবিবার দুপুরে রাজধানীর কারওয়ানবাজারস্থ র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
তিনি জানান, গত ৩১ আগস্ট রাতে যাত্রীবেশে রাজধানীর গাবতলী থেকে ছেড়ে যাওয়া হানিফ পরিবহনের একটি বাসে উঠে ডাকাতদলের সদস্যরা। রাত ৩টার দিকে ধাপেরহাট এলাকায় পৌঁছলে বাসটির নিয়ন্ত্রণ নেয় তারা। এরপর ছুরিকাঘাতে বাসের চালক মঞ্জুর হোসেনকে (৫৫) হত্যা করে চক্রটি।
কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জানান, চাঞ্চল্যকর এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় বাসের সুপারভাইজার মো. পইমুল ইসলাম বাদী হয়ে রংপুর জেলার পীরগঞ্জ থানায় একটি মামলা করে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে র্যাব-১ ও র্যাব-১৩ এর আভিযানিক দল রাজধানীর অদূরে আশুলিয়া ও গাইবান্ধায় অভিযান পরিচালনা করে বাসচালককে হত্যাসহ ডাকাতির সঙ্গে সরাসরি জড়িত চক্রের ৬ সদস্যকে গ্রেফতার করেছে।
গ্রেফতাররা হলেন— নয়ন চন্দ্র রায় (২২), রিয়াজুল ইসলাম লালু (২২), ওমর ফারুক (১৯), ফিরোজ কবির (২০), আবু সাঈদ মোল্লা (২৫) ও শাকিল মিয়া (২৬)। এ সময় তাদের কাছ থেকে হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত ছুরিসহ ৫টি ছুরি, লুট করা একটি মোবাইল ফোন ও তাদের ব্যবহৃত ৫টি মোবাইল ফোন উদ্ধার করা হয়।
খন্দকার আল মঈন বলেন, গত ৩১ আগস্ট রাতে ঢাকা হতে পঞ্চগড়ের উদ্দেশে ছেড়ে যাওয়া হানিফ পরিবহনের একটি বাস রংপুর জেলার পীরগঞ্জ এলাকায় পৌঁছলে ডাকাতির কবলে পড়ে। ওই বাসে যাত্রীবেশী ডাকাত দলের সদস্যদের ছুরিকাঘাতে বাসের চালক মঞ্জুর হোসেন গুরুতর আহত হন এবং পরে মারা যান। এ চাঞ্চল্যকর হত্যাসহ ডাকাতির পরিপ্রেক্ষিতে র্যাব-১ তাৎক্ষণিকভাবে হত্যাকারী ডাকাত দলের সদস্যদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনতে দ্রুততার সঙ্গে ছায়া তদন্ত শুরু করে ও গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ায়। এরই ধারাবাহিকতায় গতকাল শনিবার র্যাব-১ ও র্যাব-১৩ আভিযানিক দল রাজধানীর অদূরে আশুলিয়া ও গাইবান্ধায় অভিযান পরিচালনা করে বাসচালক হত্যাসহ ডাকাতির সঙ্গে সরাসরি জড়িত ৬ জনকে গ্রেফতার করে।
তিনি আরও বলেন, গত ৩১ আগস্ট রাত ৮টার দিকে হানিফ পরিবহনের একটি নন-এসি বাস (ঢাকা মেট্রো-গ-১৫-৩৮১০) ঢাকা হতে পঞ্চগড়ের উদ্দেশে গাবতলী ছেড়ে যায়। বাসটি সাভারে পৌঁছলে পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী ডাকাত দলের তিনজন (রিয়াজুল ইসলাম ওরফে লালু, আবু সাঈদ মোল্লা ও অপর একজন) এবং নবীনগর পৌঁছলে ডাকাত দলের আরও তিনজন (শ্রী নয়ন চন্দ্র রায়, ওমর ফারুক ও ফিরোজ কবির) যাত্রীবেশে বাসে ওঠে। রাত আনুমানিক আড়াইটার দিকে বাসটি গাইবান্ধার পলাশবাড়ী উপজেলার বিটিসি মোড় অতিক্রম করার পর বাসে যাত্রীবেশে থাকা ডাকাত দলের সদস্যরা ডাকাতির উদ্দেশ্যে বাসটি তাদের নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার চেষ্টা করে। প্রথমে তারা বাসের চালক মঞ্জুর হোসেনকে ধারালো ছুরি দিয়ে আঘাত করে। এ সময় চালক বাসটি ঘুরিয়ে আনার চেষ্টা করলে তারা আবার চালকের কাঁধে ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে বাসটির নিয়ন্ত্রণ নেয়। এরপর ডাকাত দলের সদস্য রিয়াজুল ইসলাম ওরফে লালু বাসটি চালাতে থাকে ও দলের অন্য সদস্যরা বাসে লুটপাট করতে করতে রংপুরের শটিবাড়ীস্থ ভাবনা ফিলিং স্টেশনে ইউটার্ন করে আবার উল্টো পথে রওয়ানা করে।
র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক জানান, পলাশবাড়ী পৌঁছনোর আগে ডাকাতেরা ঢাকা-রংপুর মহাসড়কে পীরগঞ্জের চম্পাগঞ্জ হাইস্কুলের সামনে রাত তিনটার দিকে যাত্রীসহ বাসটি রেখে পালিয়ে যায়। এ সময় ডাকাতরা যাত্রীদের মুঠোফোন ও নগদ ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা লুট করে পালিয়ে যায়। পরবর্তীকালে গুরুতর আহত অবস্থায় বাসচালক মঞ্জুর হোসেনকে পলাশবাড়ী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে কতর্ব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
গ্রেফতারদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে র্যাবের এ মিডিয়া উইং কর্মকর্তা বলেন, তারা একটি সংঘবদ্ধ ডাকাত দলের সক্রিয় সদস্য। দলটির সদস্য ১০ থেকে ১২ জন। গ্রেফতার নয়ন চন্দ্র রায় ডাকাত দলের মূলহোতা। সে ডাকাত দলটি নিয়ন্ত্রণ করত। দলের সদস্যরা দীর্ঘদিন উত্তরবঙ্গগামী বাসে সাধারণ যাত্রীবেশে উঠে ডাকাতি করে আসছিল। তারা গত বছরের ডিসেম্বর থেকে এ পর্যন্ত ৭ থেকে ৮টি বাসে ডাকাতি করেছে বলে জানিয়েছে। ইতঃপূর্বে ডাকাত চক্রটি পলাশবাড়ী থেকে পীরগঞ্জ ৪৮ কিলোমিটার এলাকায় গত বছরের ১৮ ডিসেম্বর রত্না স্পেশাল, ১ জানুয়ারি সিটিবাড়ি স্পেশাল, ১২ জানুয়ারি সৈকত পরিবহন, ৮ মার্চ শ্যামলী পরিবহন, ৪ এপ্রিল জায়দা পরিবহন ও ১৯ আগস্ট ডিপজল পরিবহনে ডাকাতি করছে বলে স্বীকার করেছে।
তিনি আরও জানান, সাধারণত, তারা পলাশবাড়ী থেকে পীরগঞ্জ মহাসড়কের নির্জন এলাকা বাস ডাকাতির জন্য বেছে নেয়। ডাকাতি করার পর তারা ফের আশুলিয়ায় ফিরে আসত।
র্যাব জানিয়েছে, জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতার নয়ন চন্দ্র জানান, সে চক্রের মূলহোতা। চক্রের অন্য সদস্যরা আশুলিয়ায় বিভিন্ন গার্মেন্টসে খণ্ডকালীন চাকুরি, ক্ষুদ্র ব্যবসা, অটোচালকসহ বিভিন্ন পেশায় জড়িত ছিল। গ্রেফতার শাকিলসহ আরও কয়েকজন সদস্য গাইবান্ধায় বিভিন্ন পেশায় জড়িত। রিয়াজুল ইসলাম ওরফে লালু পেশায় ট্রাকচালক। সে তার অন্য সহযোগীদের সঙ্গে বাস ডাকাতির সময় বাসের চালকের পরিবর্তে নিজে বাস চালিয়ে ডাকাত সদস্যদের গন্তব্যে নিয়ে যেত। শাকিল ডাকাতির স্থানে উপস্থিত থেকে তথ্য ও অন্যান্য সহায়তা প্রদান করত। গ্রেফতার অন্য সদস্যরা সশরীরে ডাকাতিতে অংশ নিত। গ্রেফতাররা একে অপরের যোগসাজশে দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন বাসে সাধারণ যাত্রীবেশে উঠে ডাকাতি করে আসছিল।
ডাকাতিকালে কী ধরনের অস্ত্র ব্যবহার করা হতো, জানতে চাইলে র্যাবের এ মিডিয়া উইং কর্মকর্তা বলেন, ডাকাতরা বেশিরভাগ সময় ছুরি ব্যবহার করেছে। ছুরি ব্যবহার করেই সবশেষ ডাকাতি সম্পন্ন করেছে তারা।
সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে খন্দকার আল মঈন বলেন, যাদের আমরা গ্রেফতার করেছি, তাদের বেশিরভাগের বাড়িই গাইবান্ধা ও রংপুর অঞ্চলে। পলাশবাড়ী-রংপুর-পীরগঞ্জ রুটের ৪৮ কিলোমিটার এলাকা সম্পর্কে ডাকাত দলের ভালো ধারণা ছিল। যে কারণে ডাকাতির জন্য এ এলাকাগুলো বেছে নিত তারা। এসব রাস্তা কখন নিরিবিলি থাকে, সেটা জেনেই অধিকাংশ সময় তারা নাইট কোচে ডাকাতি করত। চক্রটি দুটি স্পটে ওয়াচম্যান রাখত। তাদের কাজ ছিল, রাস্তায় আশপাশের মানুষের আনাগোনা আছে কি-না বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা আছে কি-না, সেটা লক্ষ্য রাখা। এসব সড়কের কোথাও সিসিটিভি ক্যামেরা না থাকায় তাদের ধারণা ছিল, এখানে ডাকাতি করলে কেউ তাদের শনাক্ত করতে পারবে না।
এসব সড়কে অপরাধ দমনে র্যাবের কোনো পদক্ষেপ আছে কি-না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, র্যাবের পাশাপাশি হাইওয়ে পুলিশ টহল দিয়ে থাকে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী প্রতিনিয়ত বিভিন্ন গাড়ি বা যাত্রীদের চেক করে থাকে। আমরা তাদের নজরদারির মধ্যে রেখেছি। এসব অপরাধীরা ডাকাতি দিন সন্ধ্যা থেকে বিভিন্ন সড়কে নজরদারি রাখত। সুযোগ পেলেই তারা ডাকাতি করত। যেহেতু পরিবহন সেক্টর ও হাইওয়েতে ডাকাতি বেড়ে গেছে, আমরাও টহল জোরদার করেছি। হাইওয়ে পুলিশও নিশ্চয় তাদের টহল জোরদার করেছে।