মাল্টি-বিলিয়ন ডলার নাসির গ্রুপের ভবিষ্যৎ কী?
নিজস্ব প্রতিবেদক || বিজনেস ইনসাইডার

গ্রাফিক্স: বিজনেস ইনসাইডার বাংলাদেশ
ঢাকা (১৩ সেপ্টেম্বর): দেশের বিশিষ্ট শিল্পপতি নাসির উদ্দিন বিশ্বাস (৭৮) সোমবার সকালে ঢাকার একটি হাসপাতালে ইন্তেকাল করেছেন। মৃত্যুর পর তিনি রেখে গেছেন নিজ হাতে গড়ে তোলা এক ডজনের বেশী বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান। একক ভাবে গড়ে তোলা এ প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় নেই তেমন কোনো কর্পোরেট অবকাঠামো। মূলত তিনি একক ভাবেই ব্যবসা পরিচালনা করতেন। তার পরিবারেও রয়েছে স্বার্থের দ্বন্দ্ব। তাই এ বিশাল শিল্প প্রতিষ্ঠানে ভবিষ্যৎ কী হবে সেটা নিয়ে স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
নাসির উদ্দিন বিশ্বাস ছিলেন নাসির গ্রুপ অফ ইন্ডাস্ট্রিজের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক। এ শিল্প প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বাজারে এসেছে প্লাস্টিক, মেলামাইন, কেডস, ফ্লোট গ্লাস, সিএফএল ল্যাম্প, গ্লাস টেবিলওয়্যার, ফ্লুরোসেন্টের গ্লাস টিউব, বিদ্যুৎ-সাশ্রয়ী বাতিসহ আরো অনেক পণ্য।
বিজ্ঞ এবং প্রবীণ এই শিল্পপতির হাত ধরে বাংলাদেশে এমন কিছু শিল্প প্রতিষ্ঠা হয়েছে, যা ছিল এদেশে 'প্রথম'। বাংলাদেশে তার প্রবর্তিত 'প্রথম' শিল্পের মধ্যে রয়েছে: মেলামাইন, ক্যানভাস জুতা কোম্পানি (জাম্প কেডস), ফ্লোট গ্লাস, সিএফএল ল্যাম্প, গ্লাস টেবিলওয়্যার এবং ফ্লুরোসেন্ট গ্লাস টিউব এবং বিদ্যুৎ-সাশ্রয়ী বাতি।
দেশের ব্যবসায়ী মহলে তিনি নতুন আধুনিক পণ্য উদ্ভাবন এবং বৈচিত্র্যের জন্য সুপরিচিত ছিলেন। তিনি ১৯৭০ এর দশকের গোড়ার দিকে তামাকের ব্যবসার মাধ্যমে ব্যবসা শুরু করলেও, পরে তিনি তার ব্যবসাকে বহুমুখী বিভিন্ন খাতে প্রসারিত করেছেন।
২০০৯ সালে নাসির উদ্দিন বিশ্বাস এই প্রতিবেদককে বলেছিলেন, আমি সবসময় নতুন কিছু সৃষ্টিতে বিশ্বাস করি। আমি এমন পণ্যের সন্ধান করার চেষ্টা করি যেগুলো বাংলাদেশে উৎপাদিত হয় না, কিন্তু বাজারে সেই পণ্যে চাহিদা রয়েছে। তিনি সবসময় বিকল্প পণ্য আমদানির কথা ভাবতেন, যার প্রমাণ তার প্রতিষ্ঠিত শিল্পে স্পষ্ট।
কুষ্টিয়ার কৃষক পরিবারের সন্তান নাসির উদ্দিন বিশ্বাস শিক্ষাগত যোগ্যতায় বাণিজ্য স্নাতক ছিলেন। তিনি একটি কারখানা স্থাপনের আগে সবসময় বাজারের কেমন প্রতিযোগিতা রয়েছে এবং কাঁচামালের সহজলভ্যতার বিষয়টি বিবেচনা করতেন। যেমন, ফ্লোট গ্লাস ফ্যাক্টরি স্থাপনের আগে, তিনি নিজে ভারতের বাজার সমীক্ষা করেছিলেন।
তিনি এক দশক আগে এই সংবাদদাতাকে বলেছিলেন, ভারতের গ্লাস কোম্পানিগুলো বাংলাদেশ থেকে অনেক দূরে সেদেশের পশ্চিম ও দক্ষিণাঞ্চলে অবস্থিত। তাই ভারতীয় কোম্পানিগুলো আমার ব্যবসার জন্য কোনো ধরনের হুমকি সৃষ্টি করেনি।
নাসির গ্রুপ ২০০৫ সালে গাজীপুরের শ্রীপুরে একটি কারখানার সাথে ফ্লোট গ্লাস ব্যবসায় প্রবেশ করে। এখন ওই ফ্যাক্টরি প্রতিদিন ৪০০ টন গ্লাস উৎপাদন করতে পারে। স্থানীয় ভোক্তাদের ক্রমবর্ধমান চাহিদার কারণে নাসির গ্রুপ তিন বছর আগে টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে প্রতিদিন ৬০০ টন উৎপাদনক্ষমতার দ্বিতীয় আরেকটি গ্লাস ফ্যাক্টরি স্থাপন করে।
এই দুটি কারখানার সম্মিলিত উৎপাদন এখন দেশের চাহিদা মেটায়, যার পরিমাণ প্রতি মাসে প্রায় ৩০,০০০ টন। শিল্পসংশ্লিষ্টদের মতে আর্থিক মূল্যের বিবেচনায় বাংলাদেশে ফ্লোট গ্লাসের বাজার এখন বছরে ২০,০০০ কোটি টাকার বেশি হবে। এক্ষেত্রে নাসির গ্রুপ রয়েছে বাজারের শীর্ষে।
এভাবেই তার বিচক্ষণ ব্যবসায়িক দক্ষতা এবং প্রজ্ঞা তাকে শীর্ষ ব্যবসায়ী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। এখন মৃত্যুর পর তিনি এক ডজনেরও বেশি শিল্প প্রতিষ্ঠান রেখে গেছেন। এর বেশিরভাগই বাংলাদেশের অনন্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত এবং বর্তমান বাজারের শীর্ষে অবস্থান করছে। নাসির গ্রুপের বর্তমান বার্ষিক টার্নওভার ৫,০০০ কোটি টাকার কম নয়।
এখন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে মাল্টি বিলিয়ন ডলারের নাসির গ্রুপ অফ ইন্ডাস্ট্রিজের পরবর্তী ভবিষ্যৎ কী হবে?
নাসির গ্রুপ মূলত একটি পারিবারিক প্রতিষ্ঠান। পেশাদার এবং ব্যবসা পরিচালনায় অভিজ্ঞদের মাধ্যমে পরিচালিত এর কোনও কর্পোরেট কাঠামো নেই। তাই স্বাভাবিক ভাবেই এ শিল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। নাসির উদ্দিন বিশ্বাস নিজে একহাতেই প্রায় সমস্ত শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছিলেন।
এছাড়া তার পারিবারে দ্বন্দ্বও রয়েছে। তিনি দুবার বিয়ে করেছেন এবং দুই পরিবারের মধ্যেই দ্বন্দ্ব রয়েছে। পারিবারিক দ্বদ্বের বিষয়টি বেশ কয়েক বছর আগে একটি ঘটনায় স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। কয়েক বছর আগে তার প্রথম স্ত্রীর বড় ছেলে নাসির গ্লাস ইন্ডাস্ট্রিজের ব্যবস্থাপনা বিভাগকে নিজের দখলে নেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন।
নাসির উদ্দিন বিশ্বাস বেশ কয়েক বছর আগে এই সংবাদদাতারকে বলেছিলেন, “আমি আমার ছেলে ও মেয়েকে নাসির গ্লাসের বেশিরভাগ শেয়ার উপহার দিয়েছিলাম। এরপরে, তারা কোম্পানির বেশিরভাগ শেয়ারের মালিক হওয়ায়, তারা গোপনে জয়েন্ট স্টক কোম্পানি ও ফার্মের রেজিস্টারের কাছে কোম্পানি পরিচালনার দায়িত্ব নেওয়ার জন্য আবেদন করেছিল।
বিষয়টি জানতে পেরে তিনি কষ্ট পেলেও হতাশায় মুষড়ে পড়েননি। তিনি এই সংবাদদাতাকে বলেছিলেন, “আমি তাদের উপহার দেওয়া সমস্ত শেয়ার ফিরিয়ে নিয়েছি এবং কোম্পানিতে আমার শেয়ার পুনর্বহাল করেছি।”
এই পরিস্থিতি বিবেচনায়, মাল্টি-বিলিয়ন ডলার নাসির গ্রুপের দায়িত্ব এখন কে নেবে তা একটি বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। কারণ পারিবারিক দ্বন্দ্বের কারণে কোম্পানির কোনো উত্তরাধিকার নির্ধারণ করা হয়েছে কি না সে বিষয়টি এখনো স্পষ্ট নয়।