স্থানীয় বাজারে পাটের উচ্চমূল্য
বিশ্বে চাহিদা হ্রাস: আকিজ ব্রাদার্সের আদমজী পরিকল্পনা বাধাগ্রস্থ
নিজস্ব প্রতিবেদক || বিজনেস ইনসাইডার

গ্রাফিক্স: বিজনেস ইনসাইডার বাংলাদেশ
ঢাকা (১৩ সেপ্টেম্বর): নিজেদেরকে ‘বাংলাদেশের নতুন আদমজী’ হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছিল আকিজ ব্রাদার্স। কিন্তু স্থানীর বাজারে কাঁচা পাটের উচ্চমূল্য এবং করোনা ভাইরাসের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে পাটজাত পণ্যের চাহিদা হ্রাস পাওয়ায় আপাতত তাদের এ পরিকল্পনা বাধাগ্রস্থ হয়েছে।
পাটকল সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, অন্যান্য অনেক পাটকলের মতো বতর্মান পরিস্থিতিতে আকিজ গ্রুপেও অবিক্রিত পণ্যের মজুদ জমে গেছে। তাই তাদেরকেও উৎপাদন হ্রাস করার পাশাপাশি উৎপাদন ইউনিটগুলি ধারণক্ষমতার চেয়ে কম জনবল নিয়ে পরিচালনা করতে হচ্ছে।
বিশ্বব্যাপী প্রায় এক-চতুর্থাংশ পাটের সুতা সরবরাহকারী আকিজ জুট মিলস দীর্ঘদিন ধরেই দেশের বাজারে শীর্ষে অবস্থান করছে। এ জুট মিলে দৈনিক প্রায় ৪০০ টন পাট সুতা উৎপাদনের ক্ষমতা রয়েছে।
গত বছর, বাজারে নিজেদের অবস্থান আরও জোরালো করতে আকিজ গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শেখ বশির উদ্দিন ব্যক্তিগতভাবে ৭২৫ কোটি টাকায় দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সুতা প্রস্তুতকারী জনতা জুট মিলস এবং সাদাত জুট মিল কিনে নিয়েছিলেন।
এছাড়া, আকিজ গ্রুপের চেয়ারম্যান শেখ নাসির উদ্দিন ফরিদপুরে দৈনিক ৬০০ টন সুতা উৎপাদনের ক্ষমতাসম্পন্ন একটি বিশাল মিল স্থাপনের কাজ করছেন। এসব মিলগুলি উৎপাদন শুরু করলে, তাদের সম্মিলিত উৎপাদন দেশের পাট ব্যবসায় একচেটিয়া আধিপত্য প্রতিষ্ঠা এবং আন্তর্জাতিক পাট সুতার বাজারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হবে।
কিন্তু, নতুন আদমজী হয়ে ওঠার জন্য কৌশল তৈরীর করার আগেই, ২০২০ সালে কাঁচা পাটের দাম বেড়ে প্রতি মণ (৩৭.৫ কেজি) ৬,৫০০ টাকা হলে আকিজ ব্রাদার্স প্রথম বড় ধরণের ধাক্কা খায়। এর ফলে পাটের সুতার দাম যথেষ্ট পরিমাণে বেড়ে দাঁড়ায় ২,২০০ ডলার টন। এ অবস্থায়, আকিজ এবং জনতা জুট মিলে অবিক্রিত সুতার মজুদ জমে গেছে।
আকিজ গ্রুপের দায়িত্বশীল এক ব্যক্তি বিজনেস ইনসাইডার বাংলাদেশকে বলেন, ‘গত বছর বন্ধ হওয়া বিজেএমসির কিছু মিল আকিজ গ্রুপ ইজারা নিতে আগ্রহী ছিল। কিন্তু পাটের বাজারের ক্রমবর্ধমান পরিস্থিতি তাদের এ পদক্ষেপ থেকে বিরত থাকতে বাধ্য করেছে।’
তিনি বলেন, এখন আকিজ জুট মিলের বিপুল অবিক্রিত মাল মজুত রয়েছে। তাই কোভিড-১৯ লকডাউনের পর কারখানা ফের খোলা হলেও মালিক উৎপাদন শুরু করতে পারেননি।
আকিজ জুট মিলসের চেয়ারম্যান শেখ নাসির উদ্দিন এবং আকিজ গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও জনতা এবং সাদাত জুট মিলের মালিক শেখ বশির উদ্দিনকে তাদের বক্তব্য জানতে বিজনেস ইনসাইডার বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ফোন করা হয়েছিল এবং টেক্স মেসেজ পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু দুজনের কেউ তাতে সাড়া দেননি।
কেন এবং কিভাবে এ পরিস্থিতির সূত্রপাত?
ভারতের পর বিশ্বে প্রাকৃতিক তন্তু উৎপাদনে দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ বাংলাদেশ। সরকারি তথ্য থেকে জানা গেছে, গত পাঁচ বছর ধরে বাংলাদেশ প্রতি মৌসুমে প্রায় ৮০ বেল পাট উৎপাদন করছে। এসব পাটের অধিকাংশই সুতা তৈরিতে ব্যবহার করা হয়েছে।
বর্ষার বন্যায় উৎপাদনে ক্ষতি হওয়ায় গত মৌসুমে পাটের দাম প্রতি মণ ৬,৫০০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। কাঁচা পাটের এই অস্বাভাবিক উচ্চ মূল্য সুতার দাম ৫০ শতাংশের বেশি বাড়িয়ে প্রতি টনে ২২০০ ডলারে উন্নীত করে।
বাংলাদেশ জুট ডাইভার্সিফায়েড প্রোডাক্টস ম্যানুফেচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স আ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট রাশেদুল করিম মুন্না বলেন, ‘বাংলাদেশে পাটের অস্বাভাবিক উচ্চ মূল্য অনেক বিদেশী ক্রেতাকে সাম্প্রতিক মাসগুলিতে অর্ডার দেওয়া থেকে বিরত থাকতে বাধ্য করেছে। প্রকৃতপক্ষে, গত তিন মাসে কোনো অর্ডারই আসেনি।’
ইরান ও তুরস্ক হচ্ছে বাংলাদেশের পাটের সুতার প্রধান বাজার। কার্পেট তৈরিতে মূলত এ পাট ব্যবহৃত হয়। কিন্তু চলমান কোভিড-১৯ মহামারি অন্যান্য দেশের মতো সেখানকার ব্যবসায়ও প্রভাব ফেলেছে।
মুন্না বলেন, ‘তবুও, কার্পেট সরবরাহের জন্য তাদের অর্ডার বাকি থাকায় তারা (ইরান ও তুরস্ক) গত মৌসুমে পাটের ৫০ শতাংশ বেশি দামেও সুতা কিনেছিল। ‘কিন্তু এবার তারা অর্ডার দেওয়া বন্ধ করে দেয়ায় মিলাররা ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন।’
প্রায় ৪০ বছর ধরে পাট ব্যবসায় নিয়োজিত গোল্ডেন ফাইবার ট্রেড সেন্টারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোশতাক হোসাইন বলেন, স্বাভাবিক বাজারে ২ হাজার টাকা থেকে ২,৪০০ টাকা থেকে গত বছর এক মণ পাটের দাম ৬,৫০০ টাকায় উঠে গিয়েছিল।
তিনি জানান, একজন কৃষককে এক মণ পাট উৎপাদনের জন্য ১,৬০০ টাকা থেকে ১,৮০০ টাকা খরচ করতে হয়।
তিনি বলেন, ‘দাম বৃদ্ধির কারণে কৃষকরা লাভবান হননি। বরং গত বছর অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কারণে কিছু মজুদদার বিপুল পরিমাণ অর্থ পকেটে ভরেছেন।’
মোশতাক হোসাইন বলেন, মহামারির মধ্যেও ভোক্তাদের কিনতে হবে পাট এমন কোন অপরিহার্য পণ্য নয়। পাট খাতের অবস্থা সত্যিই খারাপ। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে এ শিল্পের কেউ নেই।
কাঁচা পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানিকারী ফাইবার অ্যান্ড ফাইবারের ব্যবস্থাপনা অংশীদার গোপি কিশোন সুরেকা বলেন, পাটের সুতার দাম তুলার দামকেও ছাড়িয়ে গেছে।
অনেক ক্রেতা এখন পাটের বিকল্প খুঁজছেন বলে তিনি উল্লেখ করেন।
গত বছরের রপ্তানি:
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ ২০২০-২১ অর্থবছরে ১১৬ কোটি ডলার মূল্যের পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি করেছে। যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৩১ দশমিক ৬৩ শতাংশ বেশি।
রপ্তানিকারকরা পণ্যের মূল্য বৃদ্ধির জন্য রপ্তানি বৃদ্ধিকে দায়ী করেছেন।
তারা বলছেন, মহামারি বিশ্বব্যাপী চাহিদা কমিয়ে দিয়েছে এবং অনেক দেশে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের ধীর হওয়ায় পরিমাণগত ভাবে রপ্তানি বাড়েনি।
বাংলাদেশ জুট স্পিনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক শহিদুল করিম বিজনেস ইনসাইডার বাংলাদেশকে জুলাই মাসে বলেছিলেন, ‘গত মৌসুমে উৎপাদন কম হওয়ায় কাঁচা পাটের দাম তিনগুণ বাড়িয়ে প্রতিমণ ৬,০০০ হাজার টাকায় উন্নীত করেছিল। এ অবস্থায় দাম বাড়ানো ছাড়া আমাদের কাছে আর কোনো বিকল্প ছিল না।’
ইপিবি তথ্য দেখা ঘেছে, মোট পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানির ৬৯ শতাংশ পাট স্পিনারদের তৈরি সুতার ওপর নির্ভরশীল।
সরকার পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানির বিপরীতে নগদ প্রণোদনা দিচ্ছে - ৭ শতাংশ (সুতার জন্য) থেকে ২০ শতাংশ (পাটের অন্যান্য পণ্য-ডাইভার্সিফাইড প্রোডাক্টস)।