বৃহস্পতিবার

২৫ এপ্রিল ২০২৪


১২ বৈশাখ ১৪৩১,

১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

ফিলিস্তিন বিরোধী কে এই নাফতালি বেনেট

রেফায়েত হোসাইন || বিজনেস ইনসাইডার

প্রকাশিত: ২২:৪২, ১৪ জুন ২০২১   আপডেট: ২২:৫৩, ১৪ জুন ২০২১
ফিলিস্তিন বিরোধী কে এই নাফতালি বেনেট

ছবি: ইসরাইলের নতুন প্রধানমন্ত্রী নাফতালি বেনেট, সংগৃহীত

ঢাকা (১৪ জুন):  ইসরাইলের পার্লামেন্ট নাফতালি বেনেটকে দেশের নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অনুমোদন দিয়েছে। রবিবার সন্ধ্যায় এ অনুমোদনের ফলে ইসরাইলে বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু শাসনের এক যুগের অবসান ঘটেছে।

মার্চে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে ব্যর্থ ইসরাইলের সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকা নেতানিয়াহু এখন জালিয়াতির অভিযোগে বিচারের সম্মুখীন হয়েছেন।

নতুন প্রধানমন্ত্রী নাফতালি বেনেট নেতানিয়াহুরই সাবেক সহযোগী এবং বিদায়ী প্রধানমন্ত্রীর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ এবং ডানপন্থী বলে পরিচিত। ইসরাইলের নাজুক সরকার যদি টিকে থাকে, তবে দু বছর পর মধ্যপন্থী ইয়ার লাপিড বেনেটের স্থলাভিষিক্ত হবেন। 

বেনেট এবং লাপিড আট দলের জোট গঠনের মতো অসাধারণ কাজ সম্পাদন করেছেন। তাদের এ জোটে ডান এবং বামপন্থীদের সঙ্গে ধর্মনিরপেক্ষ এবং ধর্মীয় দলও রয়েছে। এদের সবার সম্মিলিত জোট গঠনের একমাত্র লক্ষ্য ছিল নেতানিয়াহুকে ক্ষমতা থেকে টেনে নামানো। 

ইহুদি ধর্মাবলম্বী ৪৯ বছর বয়সী নাফাতালি বেনেটের বাস তেল আবিবের রানানা এলাকায়। চার সন্তানের বাবা বেনেট আন্তর্জাতিক অঙ্গনে খুব একটা পরিচিত মুখ না হলেও, আঞ্চলিক রাজনৈতিক পরিম্যণ্ডলে তিনি বেশ পরিচিত। মার্কিন বাবা-মায়ের সন্তান বেনেট ইসরাইলের রাজনীতিতে প্রবেশের আগে বেশ সফল প্রযুক্তি উদ্যোক্তা ছিলেন। এ ব্যবসা থেকেই তিনি মিলিয়নিয়ার হয়েছেন। এরপর তিনি ইসরাইলের ডানপন্থী রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন এবং ধর্মীয়-জাতীয়তাবাদী হিসেবে নিজের রাজনৈতিক অবস্থান তৈরি করেন। 

গ্রাফিক্স: আল জাজিরামার্কিন বংশোদ্ভুত বাবা-মায়ের ঘরে ইসরাইলের হাইফাতে জন্ম নেওয়া বেনেট উত্তর আমেরিকা এবং ইসরাইলে বেড়ে উঠেছেন। দুই জায়গাতে তিনি সেনাবাহিনী, ল’ স্কুল এবং বেসরকারি খাতের ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। এভাবে তিনি নিজেকে একজন আধুনিক, ধর্মপরায়ণ এবং জাতীয়তাবাদী ব্যক্তিত্ব হিসেবে গড়ে তুলেছেন।

এলিট সায়েরেট মাতকল কমান্ডো ইউনিটে দায়িত্ব পালনের পর বেনেট হিব্রু ইউনির্ভাসিটির ল’ স্কুলে ভর্তি হন। ১৯৯৯ সালে তিনি সহ-প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে জালিয়াতি প্রতিরোধকারী সফটওয়্যার কোম্পানি ‘কিয়োটা’ প্রতিষ্ঠা করেন। ২০০৫ সালে সেই কোম্পানি যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আরএসএ সিকিউরিটির কাছে ১৪৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের বিনিময়ে বিক্রি করে দেন।    

বেনেট বলেছেন, লেবাননের বিদ্রোহী সংগঠনের বিরুদ্ধে ২০০৬ সালের ইসরাইলের যুদ্ধের তিক্ত অভিজ্ঞতার কারণেই তিনি রাজনীতিতে যোগ দিয়েছেন। দীর্ঘ এক মাসের ওই যুদ্ধ কোনো সমাধান ছাড়াই শেষ হয়েছিল। ওই যুদ্ধের কারণে তৎকালীন ইসরাইলের সামরিক বাহিনী এবং রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ বেশ সমালোচনার মুখোমুখি হয়েছিলেন। 
 
বেনেটের কট্টর জাতীয়তাবাদী ইয়ামিনা পার্টি মার্চের নির্বাচনে ১২০ সদস্যের ইসরাইলের পার্লামেন্টে মাত্র সাতটি আসনে জয় লাভ করে। কিন্তু এত কম আসনের দাবিদার হয়েও তিনি নেতানিয়াহু বা তার প্রতিপক্ষের কাছে নতি স্বীকার না করে নিজেকে ‘কিং মেকার’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। নতুন জোট গঠনের চুক্তির প্রতিবাদে তার নিজ দলের একজন তাকে ছেড়ে গেলেও পরিশেষে বিজয়ের মুকুট তিনিই মাথায় তুলেছেন।  

জাতীয়তাবাদের প্রশ্নে নিজস্ব অবস্থানের কারণে ইসরাইলের বিভিন্ন পর্যবেক্ষক এবং পত্র-পত্রিকা তাকে ‘আল্ট্রা-ন্যাশনালিস্ট’ বলে অভিহিত করেছে। ইয়ামিনা পার্টির নেতা বেনেট ফেব্রুয়ারিতে টাইমস অব ইসরাইলকে বলেছিলেন, ‘আমি বিবির (নেতানিয়াহু) চেয়েও বেশি ডানপন্থী। কিন্তু তাই বলে আমি নিজেকে রাজনৈতিকভাবে তুলে ধরার জন্য কোনো ধরনের ঘৃণা বা পক্ষপাতিত্বেও আশ্রয় নিই না।’

বেনেট সম্প্রতি পশ্চিম-তীরের অধিকৃত এলাকা ইসরাইলের সঙ্গে যুক্ত করার আহ্বান জানিয়েছেন। বেনেটের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন ২০১৩ সালে ইসরাইলের রাজনৈতিক পরিম-লে আবির্ভূত হওয়ার পর থেকেই এ ব্যাপারে তিনি অবস্থান নিয়েছিলেন। 

বেনেট ২০০৬ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত নেতানিয়াহুর একজন সিনিয়র সহযোগী এবং চিফ অব স্টাফ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্কের তিক্ততা সৃষ্টি হওয়া পর তিনি নেতানিয়াহুর লিকুদ পার্টি ত্যাগ করেন। ইসরাইলের মিডিয়া অবশ্য এ জন্য নেতানিয়াহুর স্ত্রী সারাকেই দায়ী করে। স্বামীর ঘনিষ্ঠদের মধ্যে সারার বেশ প্রভাব রয়েছে। 

রাজনীতিতে যোগদানের পর বেনেট নিজেকে ডানপন্থী জাতীয় ধর্মীয় জিউশ হোম পার্টির দিকে ঝুঁকে পড়েন। এরপর জিউশ হোম পার্টিও প্রতিনিধি হিসেবে ২০১৩ সালে পার্লামেন্টে প্রবেশ করেন। 

বেনেট ইহুদি রাষ্ট্রের কট্টর সমর্থক বলে বিশেষভাবে পরিচিত। ১৯৬৭ সালের যুদ্ধের পর ইসরাইলের দখলে থাকা ইসরাইল-সিরিয়া সীমান্তবর্তী এলাকা, পূর্ব জেরুজালেম এবং গোলান মালভূমি, পশ্চিম তীরে ইহুদিদের ধর্মীয় ঐতিহাসিক দাবির জোরদার করছেন।  

ইহুদি বসতি স্থাপনকারীদের প্রতিনিধিত্বকারী রাজনৈতিক সংগঠন ইয়েসা কাউন্সিলের প্রধান হওয়ার পর বেনেট দীর্ঘ দিন ধরে পশ্চিমতীরে ইহুদি বসতি স্থাপনের দাবি করে আসছেন। তবে তিনি কখনোই ইসরাইলের গাজা দখলের পক্ষে কথা বলেননি। 

বলা হয়ে থাকে বেনেট ফিলিস্তিনের বিদ্রোহীদের প্রশ্নে বেশ কঠোর অবস্থান নিয়েছেন এবং তিনি তাদের জন্য মৃত্যুদ-ের সুপারিশ করেছেন। মে মাসে গাজা থেকে ইসরাইলে বিদ্রোহীদের রকেট নিক্ষেপের জবাবে ইসরাইলের বিমান হামলায় বেসামরিক জনগণের মৃত্যুর জন্য বেনেট হামাসকেই দায়ী করেছিলেন।

টাইমস অব ইসরাইল বলেছে, বেনেট রাজনৈতিক বিরোধীদের বর্জন করার মানুষ নন। ব্যক্তি হিসেবে তিনি হচ্ছেন ‘দ্য ন্যাশনাল ক্যাম্প’। একজন দৃঢ় এবং গর্বিত ডানপন্থী নেতা হিসেবে তিনি ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে ‘কোনো অবস্থাতে’ কখনোই মেনে নেবেন না। তিনি পশ্চিম তীরের ৬০ শতাংশ এলাকাতে ইসরাইলের সার্বভৌমত্ব সম্প্রসারণ করতে চান। তিনি মনে করেন, ইসরাইয়েল ইতোমধ্যে ‘বিবিলিক্যাল ল্যান্ড’র অনেকটাই দখল করে নিতে সক্ষম হয়েছে। 

ইসরাইলের বামপন্থী হারেট্জ পত্রিকায় বিশিষ্ট কলামিস্ট আনশেল ফেফার বেনেটের প্রোফাইল সম্পর্কে লিখেছেন, ‘তিনি হচ্ছে ইসরায়েল ৩.০। তিনি একজন ইহুদি জাতীয়তাবাদী, তবে বাস্তব বিবর্জিত নন। তিনি ধার্মিক, তবে কট্টরপন্থী নন। তিনি সামরিক বাহিনীর সদস্য হয়েও বেসামরিক নাগরিক জীবনে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। তিনি প্রযুক্তি উদ্যোক্ত হলেও আরও অর্থ বানানোর পক্ষপাতি নন। তিনি ইসরাইলের সম্প্রসারণের পক্ষে, তবে দখলদারিত্বের পক্ষে নন। তিনি হয়তো আজীবন রাজনীতির সঙ্গেও সম্পৃক্ত থাকবেন না।’ 

ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বেনেটের উত্থানের অর্থ হচ্ছে ফিলিস্তিনের শান্তি স্বাধীন রাষ্ট্র নিয়ে আলোচনার প্রত্যাশাকারীদের জন্য একটি বড় ধরনের ধাক্কা। 

সূত্র: ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, এপি, আল-জাজিরা 
 

Nagad
Walton

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়