বৃহস্পতিবার

২৫ এপ্রিল ২০২৪


১২ বৈশাখ ১৪৩১,

১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

কুরবানী: তাৎপর্য, গুরুত্ব ও ফজীলত

মাওলানা লিয়াকত আলী মাসঊদ || বিজনেস ইনসাইডার

প্রকাশিত: ১৪:২৭, ২১ জুলাই ২০২১   আপডেট: ০৩:২০, ২২ জুলাই ২০২১
কুরবানী: তাৎপর্য, গুরুত্ব ও ফজীলত

গ্রাফিক্স: বিজনেস ইনসাইডার বাংলাদেশ

মানব সভ্যতার উষালগ্ন থেকে কুরবানীর প্রচলন ছিল। অবশ্য পদ্ধতি ও আঙ্গিক ছিল ভিন্ন।

আল কুরআনের ভাষ্য অনুযায়ী কুরবানীর সূচনা হয় আদম (আঃ) দুই ছেলের মাধ্যমে। তারা হলেন হাবিল ও কাবিল। হাবিল প্রথম মানুষ যে আল্লাহর জন্য একটি পশু কুরবানী করেন। ইবনে কাসীর বর্ণনা করেছেন যে, হাবিল একটি ভেড়া এবং তার ভাই কাবিল তার ফসলের কিছু অংশ স্রষ্টার উদ্দেশ্যে নিবেদন করে।

নিয়মানুযায়ী হাবিলের কুরবানী আগুনে ভস্মীভূত হয়ে কবুল হয়।

পক্ষান্তরে কাবিলের কুরবানীর ফসল প্রত্যাখ্যান করে। কাবিল এই ঘটনায় ঈর্ষান্বিত হয় ও সামাজিভাবে অপমানবোধ করে কুরবানী কবুল না-হওয়ার বিষয়টি নিয়ে এক পর্যায়ে তার ভাই হাবিলকে হত্যা করে, যা মানব ইতিহাসের প্রথম হত্যাকাণ্ড হিসেবে পরিচিত। কাবিল তার কৃতকর্মের জন্যে অনুতপ্ত না হওয়ায় আল্লাহ তাকে ক্ষমা করেননি।

অতপর নবী ইব্রাহীম (আঃ)-কে মহান আল্লাহ তা‘আলা স্বপ্নযোগে তাঁর সবচেয়ে প্রিয় বস্তুটি কুরবানী করার নির্দেশ দেন— “তুমি তোমার প্রিয় বস্তু আল্লাহর নামে কুরবানী কর।” ইব্রাহীম (আঃ) স্বপ্নে এ আদেশ পেয়ে ১০টি উট কুরবানী করলেন। পুনরায় তিনি একই স্বপ্ন দেখলেন। ইব্রাহীম (আঃ) আবার ১০০টি উট কুরবানী করেন। তারপরেও তিনি একই স্বপ্ন দেখে ভাবলেন, আমার কাছে তো এ মুহূর্তে প্রিয় পুত্র ইসমাইল (আঃ) ছাড়া আর কোনো প্রিয় বস্তু নেই। তখন তিনি পুত্রকে কুরবানীর উদ্দেশ্যে আরাফাতের ময়দানের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। যখন ইব্রাহীম (আঃ) আরাফাত পর্বতের উপর তাঁর পুত্রকে কুরবানী দেওয়ার জন্য গলদেশে ছুরি চালানোর চেষ্টা করেন, তখন তিনি বিস্মিত হয়ে দেখেন যে তাঁর পুত্রের পরিবর্তে একটি প্রাণী কুরবানী হয়েছে এবং তাঁর পুত্রের কোনো ক্ষতি হয়নি। 

হযরত ইবরাহীম (আঃ)-এর ত্যাগের মহিমাকে সমুজ্জ্বল রাখার লক্ষ্যে ইসলামে নবী মুহাম্মদ (সাঃ)-এর মাধ্যমে সারা বিশ্বের মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য প্রতি বছর এই দিবসটি ঈদুল আযহা নামে উদযাপনের নির্দেশ দেওয়া হয়।

কুরবানীর তাৎপর্য 
মানুষ আল্লাহর সেরা সৃষ্টি। আপন সেরা সৃষ্টিকে দয়াময় আল্লাহ নানা উপায়ে স্বীয় সান্নিধ্য ও নৈকট্য দান করেন। এ সকল উপায়ের অন্যতম হল কুরবানী। মূলতঃ কুরবানী হল— নৈকট্য, ঘনিষ্ঠতা ও সান্নিধ্য লাভের উপায় মাত্র।

‘কুরব’ ও ‘কুরবানী’র আভিধানিক অর্থ হলঃ কাছে যাওয়া, আপন হওয়া বা নৈকট্য লাভ করা। আর যেহেতু কুরবানীর মাধ্যমে মানুষ তার আপন মালিক ও স্রষ্টার নৈকট্য ও ঘনিষ্ঠতা অর্জন করে থাকে সেহেতু একে কুরবানী বলা হয়।

হযরত ইবরাহীম (আঃ)-ও তদীয় পুত্র ইসমাঈল (আঃ)-এর মহান ত্যাগের স্মৃতি বিজড়িত কুরবানী যেমন হজ্জের বিধানের অন্তর্ভূক্ত তেমনি এটি সাধারণভাবে সামর্থ্যবান প্রত্যেক মুসলমানের উপরও আবশ্যকীয় (ওয়াজিব)।

কুরবানির ফযিলত
কুরবানী অত্যন্ত ফযীলতপূর্ণ আমল। হাদীস শরীফে আছে, হযরত যায়দ ইবনু আরকাম (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, সাহাবায়ে কিরাম আরয করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ (সাঃ), কুরবানী কী? রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, তোমাদের পিতা হযরত ইবরাহীম (আঃ)-এর সুন্নাত। সাহাবায়ে কিরাম আবার আরয করলেন, এতে আমাদের কী কল্যাণ নিহিত রয়েছে? রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, এর প্রত্যেকটি পশমের বিনিময়ে একটি করে নেকী রয়েছে। তোমরা মোটা তাজা পশু যবেহ করো। কেননা এগুলো পুলসিরাতে তোমাদের বাহন হবে। [ইবনু মাজাহ]

হযরত আয়িশা (রাঃ) বর্ণিত অপর এক হাদীসে আছে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ইরশাদ করেছেন, ঈদের দিনে আদম সন্তানের সর্বোৎকৃষ্ট আমল হল কুরবানী করা। কুরবানীদাতা কিয়ামতের দিন কুরবানীকৃত পশুর শিং, লোম ও হাড়গুলোসহ উপস্থিত হবে। নিংসন্দেহে কুরবানীর উদ্দেশ্যে যবেহকৃত পশুর রক্ত যমীনে পড়ার আগেই তা আল্লাহ’র দরবারে কবূল হয়ে থাকে। [তিরমিযী, ইবনু মাজাহ]

কুরবানী আল্লাহর দরবারে মকবূল হবার ক্ষেত্রে একটি বিশেষ শর্ত অবশ্য রয়েছে। আর তা হল— কুরবানীদাতার নিয়ত অবশ্যই খালিস হতে হবে। কুরবানীর মূল উদ্দেশ্য হতে হবে আল্লাহর ভয় ও তাঁর সন্তুষ্টি। কুরআন মজীদের ভাষ্যানুযায়ী তাকওয়ার ভিত্তিতে কৃত কুরবানীই কেবল কবূল হয়ে থাকে।

কুরবানীর গুরুত্ব
কুরবানী আল্লাহর একটি বিধান। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন, “তোমার প্রতি পলকের উদ্দেশ্যে সালাত আদায় কর এবং কুরবানী কর।” [সুরা আল কাউসার-২] তাফসীরে হুকুল মাআনির ভাষ্যমতে কতিপয় ইমাম ঐ আয়াত দ্বারা কুরবানীর ওয়াজিব হওয়াকে প্রমাণ করেছেন। আল্লাহর নির্দেশ পালন মূলতঃ ফরজ বা ওয়াজিব। তাই সামর্থ্যবান সকল মুসলমানদের ওপর কুরবানী করা আবশ্যক। হাদীসে হযরত যায়েদ ইবনে আরকান (রাঃ) হতে বর্ণিত হয়েছে সাহাবাদের কেউ কেউ রাসূল (সাঃ)-কে জিজ্ঞাসা করলাম, হে রাসূল (সাঃ) পশমের ব্যাপারে কী হবে? তিনি বললেন প্রতি পশমের বদলে একটি করে নেকি পাওয়া যাবে। [ইবনে মাজাহ, আবু দাউদ, মুসনাদে আহমদ, হাকিম]

রাসুল (সাঃ) বলেছেন যে ব্যক্তি সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কুরবানী করে না সে যেন আমার ঈদগাহে না আসে।’ [ইবনে মাজাহ ৩১২৩, হাদীসটি হাসান]

২০ জুলাই ২০২১, ঢাকা

লেখক: কওমী মাদ্রাসার শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক

*এই লেখার তথ্য ও বানানরীতি লেখকের
 
Nagad
Walton

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়