শুক্রবার

২৬ এপ্রিল ২০২৪


১৩ বৈশাখ ১৪৩১,

১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

দুই শ’ বছরের ঐতিহ্যবাহী মুক্তাগাছার মণ্ডা

ময়মনসিংহ সংবাদদাতা  || বিজনেস ইনসাইডার

প্রকাশিত: ১৬:৫৪, ৯ এপ্রিল ২০২১   আপডেট: ১৪:০৬, ১১ মে ২০২২
দুই শ’ বছরের ঐতিহ্যবাহী মুক্তাগাছার মণ্ডা

দুই শ’ বছরের ঐতিহ্যবাহী মুক্তাগাছার মণ্ডা তার সুখ্যাতি ছড়িয়ে চলেছে

ময়মনসিংহ (০৯ এপ্রিল): মুক্তাগাছার মণ্ডার নাম শোনেননি এমন লোক পাওয়া মুশকিল। এ মণ্ডার খাতি আর স্বাদের কথা দেশময় ছড়িয়ে। যার কথা শুনলে যে কারো জিভে জল চলে আসে।

দুই শ’ বছর ধরে মাথা উঁচু করে আপন অবস্থা ধরে রেখেছে স্বাদে-মানে সমৃদ্ধ এ মণ্ডা। বিয়ে, জন্মদিন, আকিকা, অতিথি আপ্যায়ন, ইফতারসহ যেকোনো ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠানে মুক্তাগাছার মণ্ডা ছাড়া যেন অপূর্ণতা থেকেই যায়!

মুক্তাগাছার এ মণ্ডা দেশের সীমানা পেরিয়ে ভোজন রসিকদের হাত ধরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জনপ্রিয় খাদ্যের তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে। কিংবদন্তী হয়ে ওঠা এই মণ্ডার সঙ্গে জড়িয়ে আছে ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার ইতিহাস।

মুক্তাগাছার ঐতিহ্যবাহী মণ্ডা আসলে এক প্রকার সন্দেশ। দুধের ছানা ও চিনি দিয়ে এটি তৈরি করা হয়। মণ্ডা তৈরির বৈশিষ্ট্য কেবল মণ্ডা প্রস্তুতকারী কারিগররাই জানেন। দুই শ’ বছর আগে মণ্ডার আবিষ্কারক রাম গোপাল পাল ওরফে গোপাল পাল এক নতুন প্রকারের মিষ্টান্ন (মণ্ডা) প্রস্তুত করেন জমিদার পরিবারকে তুষ্ট করার জন্য। সেই সময়ের মুক্তাগাছার জমিদার সূর্যকান্ত আচার্য চৌধুরীকে মণ্ডা দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়। মহারাজা এ মিষ্টান্ন খেয়ে এর ভূয়সী প্রশংসা করেন।

 

ময়মনসিংহ জেলা শহর থেকে ১৬ কিলোমিটার পশ্চিমে মুক্তাগাছা পৌরসভা শহরে জমিদারবাড়ির কাছেই পূর্বদিকে রাম গোপাল পাল বা গোপাল চন্দ্র পালের মণ্ডার দোকান। জনশ্রুতি আছে, ঘুমের ঘোরে স্বপ্ন দেখে সে অনুসারে রাম গোপাল চন্দ্র পাল ওরফে গোপাল পাল এই মণ্ডা তৈরি করেছিলেন। যা সেই সময়ের জমিদারদের খুবই পছন্দের মিষ্টান্ন হয়ে ওঠে। তাদের হাত ধরে ক্রমশ উপমহাদেশের সবখানে ছড়িয়ে পড়ে এ মণ্ডার সুখ্যাতি। 

এ মণ্ডা খেয়ে তৎকালীন রাজা-জমিদাররা নানাভাবে গোপাল পালকে পুরস্কৃত ও প্রশংসিত করেছেন। গোপাল পালের দোকানটি পঞ্চম বংশধর রমেন্দ্র পালের মৃত্যুর পর তার ছোটভাইয়েরার তত্ত্বাবধানে রয়েছে।  

প্রচলিত জনশ্রুতির বিষয়ে ওই দোকানের তত্ত্বাবধায়কদের একজন বলেন, “মণ্ডা তৈরির পেছনে রয়েছে অলৌকিক ঘটনা। মণ্ডার কারিগর গোপাল পাল খুবই ঈশ্বর ভক্ত ছিলেন। পর পর কয়েক রাতে স্বপ্নে এক সন্ন্যাসী তাকে মণ্ডা তৈরির পদ্ধতি শেখান। সেই সন্ন্যাসী তাকে বলেন, ‘কাল থেকে তুই(গোপাল পাল) মণ্ডা বানানো শুরু কর’।”

তিনি আরও বলেন, “পরে ওই সন্নাসীর নির্দেশে মণ্ডা তৈরি শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে দেখলেন স্বপ্নে দেখা সেই সন্ন্যাসী স্বশরীরে উপস্থিত হয়ে মণ্ডা তৈরির উনুনে হাত বুলাচ্ছেন। তখন সন্নাসীকে ভক্তি করায় সঙ্গে সঙ্গে গোপালের মাথায় হাত রেখে বলেন, তোর হাতের মণ্ডা মিঠাই একদিন জগৎ বিখ্যাত হবে। এ আশীর্বাদ করে সন্নাসী অদৃশ্য হয়ে যায়।”

এ সময় মুক্তাগাছার মণ্ডার বিষয়ে বর্তমান দোকান তত্ত্বাবধানকারীদের একজন এই প্রতিবেদককে একটি পুস্তিকা হাতে ধরিয়ে দিলেন। ওই পুস্তিকা থেকে জানা গেল, মুক্তাগাছার মণ্ডার কারিগর গোপাল চন্দ্র পাল ১৭৯৯ সালে জন্ম গ্রহণ করেন। এবং দীর্ঘ ১০৮ বছর পর ১৯০৭ সালে মারা যান। নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতনের পর পালিয়ে গোপাল পালের বাবা রামরাম পাল তার বাবা শিবরাম পাল মুর্শীদাবাদ ছেড়ে মালদহ হয়ে রাজশাহী আসেন। এরপর চলে আসেন মুক্তাগাছার তারাটি গ্রামে। গোপাল পালের মৃত্যুর পর তার ছেলে রাধানাথ পাল, রাধানাথের ছেলে কেদার নাথ পাল, কেদার নাথের ছেলে দ্বারিকনাথ পাল এবং দ্বারিকনাথের ছেলে রমেন্দ্র নাথ পাল এই ‘পাল এন্ড ব্রাদার্স’-এ মণ্ডা তৈরি করে বিক্রি করছেন। রমেন্দ্র নাথ পাল মৃত্যুররণ করায় তার ছোট ভাইয়েরা পাল এন্ড ব্রাদার্স মণ্ডার দোকানের তত্ত্বাবধানে হয়েছেন।

ওই পুস্তিকা থেকে আরও জানা গেছে, মুক্তাগাছার জমিদার জীবেন্দ্র কিশোর আচার্য চৌধুরী রচিত ‘আমি’ বইটিতে মণ্ডার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন। তিনি কেদারনাথ পালকে প্রশংসা পত্রও দিয়েছিলেন। ঐতিহ্যের ধারক মুক্তাগাছার মণ্ডার স্বাদ নিয়েছেন উপমহাদেশের প্রখ্যাত সেতার বাদক ও সুর সম্রাট ওস্তাদ আলা উদ্দিন খাঁ, বিখ্যাত চিকিৎসক ডাক্তার বিধান চন্দ্র রায় (পরে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী), নেতাজী সুভাস চন্দ্র বসু প্রমুখ।

মুক্তাগাছার জমিদার সূর্যকান্ত মহারাজ পুত্র শশীকান্ত আচার্য চৌধুরীরও প্রিয় মিষ্টান্ন ছিল এ মণ্ডা। কথিত আছে, মহারাজ রাশিয়ার নেতা স্টালিনের কাছে এ মণ্ডা পাঠিয়েছিলেন। স্টালিন মণ্ডা খেয়ে মহারাজার কাছে প্রশংসাপত্র পাঠান। পাকিস্তান আমলে মণ্ডা ভক্ত মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী একবার মণ্ডা নিয়ে চীনে গিয়েছিলেন। আপ্যায়িত করেছিলেন চীনের নেতা মাও সেতুংকে।

পাকিস্তান আমলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তাগাছার এক সভায় এসে মণ্ডা খেয়ে প্রশংসা করেছিলেন। সে সময়ে মণ্ডার দোকানের মালিক কেদার নাথ পালকে বঙ্গবন্ধু বলেছিলে, “পাল মশাই দেশ ছেড়ে যাবেন না, দেশ ভালো হবে।”

বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর থাকাকালে মণ্ডা খেয়ে প্রশংসা করেন। পরে বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট হন তিনি। 

স্বাধীনতার পর তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশে এলে বঙ্গবন্ধু তাকে মুক্তাগাছার মণ্ডা দিয়ে আপ্যায়ন করেছিলেন। ব্রিটেনের রাণী এলিজাবেথ একবার ঢাকায় এসেছিলেন। তাকে মণ্ডা দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়েছিল। তিনিও মণ্ডার প্রশংসা করেছিলেন।

নবম জাতীয় সংসদের তৎকালীন মাননীয় স্পিকার ও বর্তমান মহামান্য রাষ্ট্রপতি এডভোকেট আব্দুল হামিদ ২০০৯ সালের ১৭ জুন সংসদে মজা করে স্থানীয় সংসদ সদস্য আলহাজ্জ খালিদ বাবুকে মুক্তাগাছার মণ্ডা খাওয়ানোর কথা বললে পরদিন তিনি ৭২০টি মণ্ডা নিয়ে হাজির হন। পরে মাগরিবের নামাজের বিরতির আগে এডভোকেট আব্দুল হামিদ সংসদ সদস্যেদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘মাননীয় সংসদ সদস্যগণ, মুক্তাগাছার মণ্ডা এসে গেছে, সরকারি ও বিরোধী দলের লবিতে দেওয়া আছে। তবে দু’টির বেশি কেউ খাবেন না।’

দেশ-বিদেশের খ্যাত নামা ব্যক্তিবর্গ, রাজনৈতক নেতৃবৃন্দ, শিল্পী-সাহিত্যিকসহ বিভিন্ন শেণী-পেশায় প্রতিষ্ঠিত মানুষজন মুক্তাগাছা এলে মণ্ডা না খেয়ে যান না। সকলেই এ রসনাবিলাসের প্রশংসা করেন।

এই ঐতিহ্যবাহী মণ্ডা তৈরি প্রতিষ্ঠানের মুক্তাগাছা ছাড়া দেশের আর কোথাও শাখা বা  শোরুম নেই। প্রতি কেজি মণ্ডা সাদা ৫০০ টাকা এবং গুড়ের মণ্ডা ৬০০ টাকা।  

মুক্তাগাছার ঐতিহ্যবাহী মণ্ডার কারিগর গোপাল পাল শত বছরেরও আগে দুনিয়া ছেড়ে  চলে গেলেও রেখে গেছেন তাঁর অনুপম কীর্তি। তাঁর মণ্ডা আজও বাঙালির রসনায় তৃপ্তি দিয়ে যাচ্ছে সুনামের সঙ্গে।
 

Nagad
Walton

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়