শুক্রবার

২৬ এপ্রিল ২০২৪


১৩ বৈশাখ ১৪৩১,

১৭ শাওয়াল ১৪৪৫

যেভাবে চুরি হয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের টাকা

আন্তর্জাতিক ডেস্ক || বিজনেস ইনসাইডার

প্রকাশিত: ২৩:৩২, ২১ জুন ২০২১   আপডেট: ২৩:৩৫, ২১ জুন ২০২১
যেভাবে চুরি হয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের টাকা

ছবি: সংগৃহীত

ঢাকা (২১ জুন): বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের টাকা চুরির ঘটনার শুরুটা হয়েছিল একটি ত্রুটিপূর্ণ প্রিন্টারের দিয়ে। এ প্রিন্টারটিকেই ঘটনার মূল বলে উল্লেখ করা যায়। মতিঝিলে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের দশম তলায় অত্যন্ত সুরক্ষিত কক্ষে প্রিন্টারটি বসানো ছিল। ওই প্রিন্টার দিয়ে ব্যাংকের বাইরে ও ভেতরে কোটি কোটি ডলার ট্রান্সফার বা লেনদেনের রেকর্ড প্রিন্ট করা হতো। একইসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রে ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (এফবিআই) এর তদন্তে আরও নানা বিষয় উঠে আসে।

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম বিবিসি ২১ জুন প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এর বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে।

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে রাখা বাংলাদেশ ব্যাংকের ৮১ মিলিয়ন ডলার সাইবার জালিয়াতির মাধ্যমে চুরির ঘটনায় বাংলাদেশসহ অন্তত ছয়টি দেশের অপরাধীরা জড়িত রয়েছে বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে।

এফবিআই’র তালিকায় সন্দেহভাজন পার্ক জিন-হিয়ক২০১৬ সালে ৫ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে আট কোটি দশ লাখ ডলার চুরি যায় এবং এই অর্থ ফিলিপিন্সের মাকাতি শহরে রিজাল ব্যাংকের শাখায় চারটি ভুয়া অ্যাকাউন্টে যায় এবং সেখান থেকে দ্রুত অর্থ তুলে নেওয়া হয়। পরে এ অর্থের মধ্যে মাত্র পনের মিলিয়ন ডলার উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে।

২০১৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি সকালে প্রিন্টারটি কাজ করছিল না। বিষয়টি সাধারণ সমস্যা ভেবে কেউ তখন তেমন আমলে নেননি। সে সময় দায়িত্ব পালনকারী ম্যানেজার জুবায়ের বিন হুদা পরে পুলিশকে জানিয়েছেন, ‘আমরা ধরে নিয়েছিলাম যে এটি অন্য যেকোনো দিনের মতো একটি সাধারণ সমস্যা। এর আগে এমন হয়েছে।’

বাংলাদেশ ব্যাংকে যে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা রয়েছে এ ঘটনার মাধ্যমে প্রথমবারের মতো সেটি প্রকাশ পেয়েছিল। প্রযুক্তিগত দুর্বলতা বা ত্রুটির কারণে হ্যাকাররা এর কম্পিউটার নেটওয়ার্কে ঢুকে পড়েছিল। হ্যাকারদের লক্ষ্য ছিল এক বিলিয়ন ডলার বা ১০০ কোটি ডলার চুরি করা। অর্থ সরাতে হ্যাকাররা ভুয়া ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, দাতব্য সংস্থা, ক্যাসিনোসহ বিভিন্ন ধরনের বিস্তৃত নেটওয়ার্ক ব্যবহার করেছে।

তদন্ত সংস্থার বিশ্লেষণ এবং তদন্তে ডিজিটাল ফিঙ্গারপ্রিন্টগুলো কেবল উত্তর কোরিয়ার সরকারের প্রতি ইঙ্গিত করেছে। এ ধরনের একটি সাইবার অপরাধের জন্য উত্তর কোরিয়াকে প্রধান সন্দেহের তালিকায় দেখে অনেকে অবাক হতে পারেন। কারণ, বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র দেশ হিসেবে পরিচিত উত্তর কোরিয়া প্রযুক্তি, অর্থনীতিসহ অন্যান্য আরো অনেক ক্ষেত্রে বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন।

মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই জানায়, উত্তর কোরিয়ার হ্যাকাররা বহু বছর ধরে পরিকল্পিতভাবে এগিয়েছে। তারা দলবদ্ধভাবে প্রস্তুতি নিয়ে সারা বিশ্বের নেটওয়ার্ক সিস্টেম ভেঙে অর্থ আত্মসাতের পরিকল্পনা করেছে। সাইবার সুরক্ষা মহলে উত্তর কোরিয়ার হ্যাকাররা লাজারাস গ্রুপ নামে পরিচিত। বাইবেলে বর্ণিত লাজারাস হচ্ছেন এমন এক ব্যক্তি, যিনি মৃত অবস্থা থেকে ফিরে এসেছিলেন। এ নামকেই বেছে নিয়েছে হ্যাকাররা। এ গ্রুপ সম্পর্কে খুব বেশি তথ্য জানা যায়নি। এফবিআই অবশ্য সন্দেহভাজন হিসেবে একজনের দিকে ইঙ্গিত করেছেন। ইনি হলেন পার্ক জিন-হিয়ক। তিনি পাক জিন-হেক ও পার্ক কোয়াং-জিন নামেও পরিচিত।

এফবিআই বলছে পার্ক জিন-হিয়ক দিনে একজন প্রোগ্রামার হিসেবে কাজ করলেও রাতে তিনি হয়ে উঠতে দুর্ধর্ষ হ্যাকার।   

বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মীরা যখন প্রিন্টারটি ফের চালু করেন, তখন তারা লক্ষ্য করেন কোথাও সমস্যা হয়েছে। তারা বুঝতে পারেন, ব্যাংক থেকে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভে জরুরি বার্তা গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রায় ১০০ বিলিয়ন ডলার ছাড় করতে ফেডারেল রিজার্ভকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভের সঙ্গে দ্রুত যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু হ্যাকাররা সময় বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রেও বেশ বৃদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছে।

হ্যাকাররা ঘটনা ঘটায় মূলত বাংলাদেশ ৪ ফেব্রুয়ারি সময় বৃহস্পতিবার রাত আটটায়। তখন ছিল নিউইয়র্কে বৃহস্পতিবার সকাল। অর্থাৎ বাংলাদেশে ব্যাংকিং কার্যক্রম বন্ধ ছিল, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে কার্যক্রম শুরু হয়েছে। অন্যদিকে, শুক্র ও শনিবার বাংলাদেশে সাপ্তাহিক ছুটি। শনিবার যখন বাংলাদেশে চুরি বিষয়টি জানা যায়, এর মধ্যে আবার নিউইয়র্কের সাপ্তাহিক ছুটি শুরু হয়ে গিয়েছিল। তাই এ চুরি বিষয়টি পুরোপুরি জানতে প্রায় তিন দিন সময় লেগেছিল।

এখানে হ্যাকাররা আরও একটি বুদ্ধি খাটায়। ফেডারেল রিজার্ভ থেকে অর্থ সরানোর পর তাদের এটি অন্য কোথাও পাঠানোর প্রয়োজন ছিল। এ ক্ষেত্রে তারা নিরাপদ জায়গা হিসেবে ফিলিপাইনের ম্যানিলাকে বেছে নেয়। কারণ, ২০১৬ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি সোমবার ছিল লুনার ইয়ারের প্রথম দিন। সেদিন সারা এশিয়ায় ছুটি ছিল। অর্থাৎ বাংলাদেশ, যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের ছুটি ও সময়ের ব্যবধানকে কাজে লাগিয়ে পাঁচ দিনে হ্যাকাররা এ কাজ করেছিল।

এ কাজ করার জন্য দীর্ঘ দিন ধরে তারা প্রস্তুতি নিয়েছিল। তদন্তে পরে জানা গেছে, লাজারাস গ্রুপ প্রায় এক বছর ধরেই বাংলাদেশ ব্যাংকের কম্পিউটারে ঢুকে লুকিয়ে কাজ করছিল।  

 

Nagad
Walton

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়